শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্তটা নিয়েই নিলাম, খুনটা হবে এবং আমিই করব। অনেকদিন নিজের সিদ্ধান্ত নেওয়ার অভ্যাস নেই, জীবনের সকল বড় বড় সিদ্ধান্তগুলোতে আমা...

একটি হত্যাকান্ড এবং আমি

শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্তটা নিয়েই নিলাম, খুনটা হবে এবং আমিই করব। অনেকদিন নিজের সিদ্ধান্ত নেওয়ার অভ্যাস নেই, জীবনের সকল বড় বড় সিদ্ধান্তগুলোতে আমার হয়ে গোটা জীবন প্রক্সি দিয়ে এসেছে বাড়িতে মা-বাবা, স্কুলে হেডস্যার, কলেজে প্রিন্সিপাল, ভার্সিটিতে ভিসি আর অফিসে বস।তাছাড়া গত এক সপ্তাহ ধরে মাথায় চিন্তাটা কামড়ে বেড়াচ্ছে, রাতে দুঃস্বপ্ন, খাওয়ায় অরুচি কাজে অন্যমনস্কতা – চিন্তা কিংবা দুশ্চিন্তার সকল লক্ষণগুলো পেরিয়ে শেষমেশ এরকম একটা চরম সিদ্ধান্ত নিতে পেরে নিজেকে বেশ মহান মনে হচ্ছে।এরকম একটা সিদ্ধান্ত কতজন নিতে পারে তাই না? আপনারাই বলুন?





অনুশোচনা? মোটেও নয়। প্রথমতঃ এখনো খুনটা করা হয় নি, শুধু খুনের সিদ্ধান্ত নিয়েই অনুশোচনা দ্বারা সংক্রমিত হওয়াটা বড্ড ছেলেমানুষি হয়ে যাবে তাই নয় কি? আর কাজটা করার পরও কোন অনুশোচনা হবে না সেটা আমি লিখে দিতে পারি। এই লোক আমার পুরো জীবনটাকে দুর্বিষহ করে দিয়েছে, এই লোক আমার পড়াশোনা, লেখালেখি, গানশোনা, মুভি দেখা সকল ইচ্ছেগুলোকেই নিজের হাতে গলা টিপে মেরেছে। এই লোকটার জন্য এত বয়স পর্যন্তও আমি কোন মেয়েকে মনের কথা বলতে পারি নি। আমার এককালের গোছানো লাইফের সর্বনাশ ঘটিয়ে আজকে সে আমাকে নামিয়েছে এই অন্ধকারে। এই যে এই ভরদুপুরে যখন কাকপক্ষী, কুত্তা-বিলাই, রিকশাওয়ালা সবাই নিজ নিজ নীড়ে আপন মনে ঘামাতে ঘামাতে ক্লান্ত তখন এই আমি কেন রাস্তার পাশের এক টং দোকানের ভাঙা বেঞ্চিতে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে আছি? কারণ আমি জানি, যদি আমি বাসায় ফিরি তবে আজইই আমি কাজটা সেরে ফেলব। কিন্তু তাড়াহুড়ো করবার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে আমার নেই, এজন্যই গত কিছুদিন বাসা থেকে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছি।



সিদ্ধান্তটা নিয়ে ফেলে একটা বড় ভার মাথা থেকে নেমে গিয়েছে। ইচ্ছেটাই বড় কথা, আজকালকার দিনে অবশ্য খুন করা এমন কিছু জটিল ব্যাপার হওয়ার কথা নয়, হরহামেশা খবরের কাগজগুলোতো সেটাই প্রমাণ করে যাচ্ছে। টাকাপয়সা হাতে থাকলে র‌্যাবকে দিয়েই হয়তো কাম তামাম করা যেত - সরকারি খুন, ক্রসফায়ার – শুনতেই বেশ লাগে। কিন্তু হাতে একেবারেই কড়ি নেই, তবে কাজটা করবার ইচ্ছে আছে – এমতাবস্থায় আমাদের বন্ধুসমাজের সকলে যা করে আমিও তাই করলাম, বন্ডভাইকে একখানা ফোন লাগালাম। বন্ডভাই ওরফে বন্ধন চৌধুরী মানুষটা চিকন, মোটে পয়তাল্লিশ কেজির একখানা শরীর – তবে তার বুদ্ধি আরো চিকন, যাকে বলে কিনা তালপাতার জেনারেল। বন্ডভাই ফোন ধরেই যথারীতি উনার পছন্দনীয় গালিখানা দিয়ে শুরু করলেন,"খান* *গী, এতদিন ছিলি কোথায়?" গালিটা অবশ্য গা করলাম না, এটা একরকম স্নেহের ডাকই বলা চলে। খুব রেখেঢেকে বন্ডভাইকে আমার সমস্যাটা বোঝালাম, কে খুন হতে যাচ্ছে সেটাও উল্লেখ করলাম না এবং স্বয়ং আমিই যে খুন করতে যাচ্ছি সে ব্যাপারটাও বেমালুম চেপে গেলাম। কাহিনীর ফাঁকফোকর টের পেলেও বন্ডভাই আমার কথায় বাগড়া দিলেন না, একবারও জানতেও চাইলেন না হঠাৎ করে কিভাবে একখানা পিস্তল জোগাড় করা যায়, বা খুন করবার পর খুন হওয়া ব্যক্তি এবং খুনীর পরিবারকে কি কি আইনি জটিলতার সম্মুখীন হতে হবে – ইত্যাদি প্রশ্নের মাজেজা কি। তিনি ধীরস্থিরভাবে আমাকে কিছু উপায় বাতলে দিলেন, কথার মাঝপথেই বুঝতে পারলাম যে আমার পরিকল্পনাটা সফল হতে যাচ্ছে। সব কথা শেষ করে তিনি শুধু যোগ করলেন,"কোন ঝামেলা হবে নাকি? আমি কি আসব?" আমি বললাম,"না ভাই, দরকার নেই। আমিই সামলাতে পারব।" ফোনটা রেখে আমি নিজের পিঠ নিজেই চাপড়ে দিলাম, বন্ডভাইকে ফোন করবার সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য। একই কাজটা হয়তো মিসিরও করে দিতে পারতো কিন্তু সে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে আসল কথা আমার পেট থেকে বের করে ফেলত, এবং আসল কাহিনী জানার পর তার ডেকোরেশনের বাঁশ খুলে নিয়ে এসে আমাকে পেটাতে চলে আসতো এতে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই।



রাত প্রায় দশটা বাজে, সব জোগাড়যন্ত্র হয়ে গিয়েছে। বন্ডভাইয়ের দেওয়া কন্টাক্টগুলো কোন ধরনের কোন প্রশ্নছাড়াই একটা "মাল" আর ছয়টা "বিচি" আমার হাতে তুলে দিয়েছে। যদিও পয়েন্ট ব্লাংক থেকে গুলি করব, মিস করবার প্রশ্নই আসে না – একটা গুলিই যথেষ্ট হতো, তবুও প্রথমবারের মতো রিভলবার লোড করব পুরোপুরিই লোড করি? তাই না? আপনারাই বলুন? প্রথম খুনের এই ছোট ছোট মজাগুলো থেকে বঞ্চিত হওয়াটা মোটেও উচিত হবে না, সুযোগ একবারই আসে। উত্তেজনায় শরীর ঘামছে, বাসার সামনের গলিতে দাঁড়িয়ে আছি, মুখে একটা সিগারেট জ্বলছে এবং পায়ের কাছে ছড়িয়ে আছে মুখের সিগারেটের আরো গোটা দশেক আধপোড়া জাতভাই। হাতে একটা ছোট ব্যাগের মাঝে জিনিসটা আছে। সামনে দিয়ে হুশহাশ করে গাড়ি যাচ্ছে, মানুষ হাঁটছে, কারো কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। কেউ জানে না আমার ব্যাগে কি আছে, মনে কি আছে সেটা জানাতো দূরে থাক। অজ্ঞানতার আনন্দে আজ সকলে নিমজ্জমান, এরাই হয়তো আগামীকাল ভোরে এইখানেই ভীড় জমাবে। উঁকিঝুঁকি মেরে দেখবার চেষ্টা করবে ভেতরে কি হচ্ছে। এই যে মোচওলা পুলিশটা আমার দিকে ভাল করে না তাকিয়েই চলে গেল, সে আমার ব্যাগ সার্চ না করবার শাস্তি পাবে আগামীকাল। করো এখন সারাদিন ডিউটি, কর্ডন কর, মানুষ ঠেকাও, সাংবাদিকদের ঠেকাও – আরে বাবা এখানেইতো দাঁড়িয়ে আমি, ব্যাগটা সার্চ করলেই লোকটার আগামীকালের সমস্ত কষ্ট বেঁচে যায়। তবুও সে দাঁড়ায় না, কেউই দাঁড়ায় না – কেবল একা আমি দাঁড়িয়ে, মধ্যরাতের অপেক্ষায়।



বাবা-মার সাথে যখন থাকতাম তখনই কোন শব্দ না করে তালা খোলার কৌশল রপ্ত করেছিলাম, মাঝে মাঝে আড্ডা শেষ করতে অনেক রাত হতো তখন কাউকে না জাগিয়েই টুক করে ঘরে ঢুকে যেতে পারতাম। তখনকার বিদ্যা আজ কাজে লাগল, পিনপতনের শব্দকেও লজ্জা পাইয়ে দেবার মতো নিরবতায় ঘরে ঢুকে গেলাম। বাথরুমের দরজা খোলা, আগে থেকেই জানি ওখানেই কাজটা সারতে হবে। উত্তেজনায় আমার সারা শরীর কাঁপছে, মস্তিষ্ক শরীরের সমস্ত কোষকে যেন আদেশ দিচ্ছে আমাকে থামানোর জন্য। মনে হচ্ছে পা যেন সীসা দিয়ে তৈরী, হাতের অস্ত্রটাকেও মনে হচ্ছে মন দুয়েক ওজনের, দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসছে। তবুও জোর করে এগোচ্ছি এক ইঞ্চি, দু ইঞ্চি করে – এইতো বাথরুমের দরজা পর্যন্ত চলে এলাম, এইতো আর দুই পা, আর এক পা... দরজায় পৌঁছে প্রায় মিনিটখানেক দাঁড়িয়ে রইলাম, বুক হাঁপরের মতো ধড়ফড় করছে, গলা দিয়ে বের হয়ে আসবে কিনা কে জানে। বড় একটা নিশ্বাস নিলাম, ঘরের সমস্ত অক্সিজেন শুষে নেওয়ার মতো বড়ো; তারপর এক ধাক্কায় ঢুকে গেলাম ভেতরে। কোন শব্দ উচ্চারণ না করেই সরাসরি কপালে অস্ত্রটা ঠেকালাম। ট্রিগার চাপার ঠিক আগমুহূর্তে আয়নাতে চোখ পড়ে মনটা বিষন্ন হয়ে গেল, মুখে তিনদিনের খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি। নিজেকে খুন করবার আগে অন্তত ফিটফাট হয়ে নেওয়া দরকার ছিল তাই না? আপনারাই বলুন, এমন সুযোগতো আর দুবার আসবে না...

৫টি মন্তব্য: