শীতের সকাল, সামনের পাহাড়ে থোকা থোকা কুয়াশা পুঞ্জীভূত হয়ে আছে মেঘের মত। একাকী একটা শিয়াল ডেকে উঠল কোথা থেকে যেন, কেউ উত্তর দিল না সে ডাকের। হঠাৎ এক দমকা হাওয়ায় কুয়াশার চাদর সরে গিয়ে দেখা গেল দুজন ঘোড়সওয়ার।
শীতের সকাল, সামনের পাহাড়ে থোকা থোকা কুয়াশা পুঞ্জীভূত হয়ে আছে মেঘের মত। একাকী একটা শিয়াল ডেকে উঠল কোথা থেকে যেন, কেউ উত্তর দিল না সে ডাকের। হঠাৎ এক দমকা হাওয়ায় কুয়াশার চাদর সরে গিয়ে দেখা গেল দুজন ঘোড়সওয়ার।
"এই চক্কর থেকে কী বের হওয়া সম্ভব?"
প্রশ্নটার মাঝে বেশ একটা বিষন্নতার সুর ছিল, যেন মৃত্যুদন্ড প্রাপ্ত কোন আসামী তার রাতের খাবারের মেনু জানতে চাচ্ছে। দ্বিতীয় ঘোড়সওয়ার তার ঘোড়ার রাশ টেনে ধরল। তার সঙ্গী বেশ আগেই থেমে গিয়েছে। ঘোড়াটা সওয়ারির হতাশার সুযোগে বেশ একটু বিশ্রাম নিয়ে নিচ্ছে, অনেক পথ পাড়ি দিয়েছে বেচারা। কিন্তু ঘোড়ার সওয়ারকে দেখে আরো বেশি ক্লান্ত মনে হচ্ছে, অদৃশ্য কোন ভার চেপে আছে যেন তাঁর কাঁধে।
"এই চক্কর থেকে কী বের হওয়া সম্ভব?"
একই রকম হেরে যাওয়া মানুষের গলায় প্রথম সওয়ারি আবারো প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিল তার সঙ্গীর দিকে। প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে দ্বিতীয় ঘোড়সওয়ার তার ঘোড়ার পেটে জুতো দিয়ে আলতো টোকা দিয়ে ঘুরিয়ে আনল। এখন সে তার সঙ্গীর মুখোমুখি, যদিও তার দৃষ্টি দিগন্তের কোন এক অজানা কোণায়।
"কী হল আবার?" সঙ্গীর হতাশার কারণ জানতে গলায় কিছুটা কৌতুহলের সুর টানার চেষ্টা করল দ্বিতীয়জন, খুব একটা সফল হল না অবশ্য। সে নিজেও ক্লান্ত।
"সবকিছু খুব গোলমাল লাগছে। অশান্তি লাগছে, কী হচ্ছে বুঝে উঠতে পারছি না।" হাত পা নেড়ে যেন শরীর থেকে অশান্তি ঝাড়তে চাচ্ছে প্রথম সওয়ার, এটা তার একটা পুরনো অভ্যাস।
"ছোট একটা পানশালা ছিল আমার, পাশে ছোট একটা জমি। সেখানে চমৎকার একটা বাগান ছিল। টকটকে লাল গাজর ফলতো, ধবধবে সাদা বেলী ফুল, রক্ত রাঙা হৃদয়ের তরমুজ।" এমনভাবে বাতাসে হাত বুলিয়ে গেল প্রথম সওয়ার যেন বাগানের ফুল তার নখাগ্রে, বেলী ফুলের সুবাস পাচ্ছে যেন।
"অবসর সময়ে আমি গান লিখতাম, ছোট একটা যাত্রার দল ছিল আমার।" মোহগ্রস্থ মানুষের মত বলেই চলছে পানশালার মালিক,"পুরো পরিবার ছিল সেই দলে। মাঝে মাঝে দূর দূরান্তে গিয়ে যাত্রাপালা করতাম, লোকজনও বেশ ভালোবাসতো আমাদের। ব্যবসাপাতি-ঘরদোর দেখতো আমার ছোটভাই। বেচারার এক পা একটু অচল, ওকে নিয়ে চলাফেরাটাও মুশকিল ছিল। "
"একদিন যাত্রা থেকে ফিরে দেখলাম আমার ভাই মুখ কাল করে বসে আছে। রাজপ্রাসাদে অনুষ্ঠান ছিল, রাজার আদেশে পানশালার মদ আর বাগানের তাজা ফল নিয়ে গিয়েছে সৈন্যরা, দামও দেয় নি। মন একটু খারাপ হল, কিন্তু কিছু বললাম না। তারপর মাসখানেক পর আবার একই কাহিনী হল, এবার কোন এক সেনাপতির বিবাহবার্ষিকীর উৎসব। দাম চাইতে গিয়ে ধমক খেলাম, কিছু বললাম না আর। তার এক সপ্তাহ পর এক মন্ত্রীর বিয়ে, তারপর এক অমাত্যের জন্মদিন, তারপর… " অভিনেতা হয়তো আরো বলত কিন্তু তার সঙ্গী তার কাঁধে হাত রাখায় সে চুপ করে একটা দীর্ঘশ্বাস নিল, চাপা ক্ষোভ যেন পাহাড়ি হিমেল বাতাসে কুয়াশা হয়ে বেরিয়ে গেল তার বুক থেকে।
"উত্তেজিত হওয়ার কিছু নেই বন্ধু।" নরম স্বরে আশ্বাস দিল অভিনেতার সঙ্গী,"নৌ বন্দরে এক চোরাকারবারির সাগরেদ ছিলাম আমি। আমি সবই দেখেছি, সবই জানি।"
"একসময় আমি জীবন নিয়ে খুব একটা চিন্তা করতাম না, মনে হত জীবন ঐ তোমার যাত্রা পালার মতই ক্ষণিকের বিনোদন।" চকিতে এক চিলতে হাসি পরশ বুলিয়ে গেল চোরাকারবারির কঠোর চেহারায়, "পরে বুঝলাম যে জীবনকে যাত্রা পালা বানিয়ে রেখেছে ঐ প্রাসাদের লোকজন। তারাই ঠিক করে আমাদের জীবনের চিত্রনাট্য, কে হবে গরিব - কে হবে রাজা। কে বেঁচে থাকবে আর কে মারা যাবে। "
"কিন্তু এই আমি আর তুমি তো ঐ চিত্রনাট্যকে অস্বীকার করে ফেলেছি বেশ আগেই, তাই না?" অভিনেতা এতক্ষণে সরাসরি চোরাকারবারির চোখের দিকে তাকাল, ভোরের সূর্যের আলোর জন্যই কিনা তার সঙ্গীর চোখ জ্বলজ্বল করছে,"এখন কথা বাড়িয়ে লাভ নেই বন্ধু, দেরি হয়ে যাচ্ছে।"
ভোরবেলায় রাজপ্রাসাদে বেশ ব্যস্ততা। হেঁশেলে বেশ একটা শোরগোল চলছে। রাঁধুনি ধমকাধামকি করছে নতশিরের কিছু সৈনিককে, এখনো সকালের তরতাজা ফলমূলের চালান এসে পৌঁছে নি। এদিকে রাজার ঘুম থেকে ওঠার সময় হল বলে। রাজপ্রাসাদের বারান্দায়, অলিন্দে বেশ ছূটোছুটি চলছে। পরিচারিকারা রাণির স্নানের প্রস্তুতি নিচ্ছে, ভৃত্যরা দৌড়াচ্ছে খাবার থালা হাতে। কেবল ঝিমাচ্ছে ওয়াচটাওয়ারে বসে থাকা প্রহরীটি। সকালের ঘন্টাটা বাজলেই সে ব্যারাকে ফিরে গিয়ে জম্পেশ একটা ঘুম দেবে। চোখ কচলে বেশ আওয়াজ করেই সে আড়মোড়া ভাঙল। শীতের সকাল, সামনের পাহাড়ে থোকা থোকা কুয়াশা পুঞ্জীভূত হয়ে আছে মেঘের মত। একাকী একটা শিয়াল ডেকে উঠল কোথা থেকে যেন, কেউ উত্তর দিল না সে ডাকের। হঠাৎ এক দমকা হাওয়ায় কুয়াশার চাদর সরে গিয়ে দেখা গেল দুজন ঘোড়সওয়ার।
অনুবাদ এবং গদ্যরূপঃ অল অ্যালং দা ওয়াচটাওয়ার - বব ডিলান
0 মন্তব্য(গুলি):