এ বছরের অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ডের জন্য মনোনয়ন পাওয়া চলচ্চিত্রগুলোর মাঝে ‘সত্য ঘটনা অবলম্বনে’ তৈরী ছবির আধিক্য দেখে আসলে অবাক হওয়ার কিছুই ...

মরণের দিনলিপিঃ ডালাস বায়ার্স ক্লাব



এ বছরের অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ডের জন্য মনোনয়ন পাওয়া চলচ্চিত্রগুলোর মাঝে ‘সত্য ঘটনা অবলম্বনে’ তৈরী ছবির আধিক্য দেখে আসলে অবাক হওয়ার কিছুই নেই। অবাক হওয়া যেতে পারে কেবলমাত্র চলচ্চিত্রগুলোর অসাধারণ এবং অবিশ্বাস্য পথচলায় অংশ নিয়ে, এরকমও তাহলে হয়? এবারের ছবিগুলো দেখার পর এটাই হবে আপনার প্রথম অভিব্যক্তি, এটা নিশ্চিত!



এ ধারায় অবশ্যই জঁ মার্ক ভালির “ডালাস বায়ারস ক্লাব”কে অনেকটাই এগিয়ে রাখতে হবে। ১৯৮০ এর প্রেক্ষাপটে একজন টেক্সান কাউবয় রন উডরুফের জীবনের শেষ সময়ের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে ছবিটির মূল কাহিনী। রন ছিলেন যাকে বলে একেবারে পেশাদার পার্টিবয় - নারী, নেশা, জুয়া আর ঝামেলায় জড়ানো ছিল তার দৈনন্দিন কার্যকলাপের নিয়মিত অংশ। কিন্তু হঠাৎ এক চেক আপের সময় ধরা পড়ল তাঁর শরীরে বাসা বেঁধেছে মরণব্যাধি এইডস, ডাক্তার তাঁকে সময় বেঁধে দিলেন। এর পর থেকেই রনের জীবন নিল এক অন্যরকম মোড়।

এতদূর পর্যন্ত কাহিনীর সারসংক্ষেপ পড়ে যদি পাঠকের ধারণা হয় যে এরপর কাহিনী হলিউদের টিপিকাল মরণব্যাধির সাথে যুদ্ধ, মৃত্যুর দিন গোণা - ইত্যাদির দিকে আগাবে তাহলে তারা খুব বড় ভুল করবেন। কারণ রন এমন একজন মানুষ যিনি কোন ধরনের বিপদকে পাত্তা দেন নি সারা জীবনে, কাজেই মৃত্যু ভয়কেও তিনি পাত্তা দেন নি। কারো দয়া প্রার্থনা করেন নি, কারো দাক্ষিণ্য নেন নি এমনকি সহানুভূতিও চান নি। বরঞ্চ নিজের এই মরণব্যাধিকে পুঁজি করে শুরু করে দিলেন ব্যবসা, এবং নিজের অজান্তেই তিনি একসময় হয়ে গেলেন মানবাধিকার লড়াইয়ের অগ্রদূত। যেই রন একসময় এইডস রোগী দেখলে ছিটকে যেতেন, তিনিই একসময় তাদের জন্য দূর দূরান্ত থেকে নতুন ঔষধ পথ্য পৌছে দিতে লাগলেন। যে সমকামীদের আজীবন ঘৃণা করতেন, তাদের রক্ষা করার জন্য দাঁড়ালেন সমাজের বিরুদ্ধে। এই ছবির কাহিনী এইডস বা মৃত্যু নিয়ে নয়, এই ছবি এক সংগ্রামের কাহিনী। রক্ষণশীল সমাজের আক্রমণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম, পুঁজিবাদী অর্থব্যাবস্থার বিরুদ্ধে সংগ্রাম এবং মুনাফালোভী সরকার এবং ওষুধ কোম্পানির বিরুদ্ধে সংগ্রামের কাহিনী।

পরিচালক ছবিটি তৈরী করেছেন অনেকটা ডকুমেন্টারির আদলে, আবেগের আতিশয্যের জায়গা নেই, বা বাড়তি কোন চরিত্রেরও ঠাঁই নেই। তবুও এর মাঝেই পুরো পর্দা আলোকিত করে ছিল রন উডরুফের চরিত্রে ম্যাথিউ ম্যাককনাহির দুর্দান্ত অভিনয়। ছবির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত রনের চরিত্রের যে বিবর্তনটা এতটা অসাধারণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন যে তাঁর অস্কার জেতাতা কেবল ঘোষণার অপেক্ষাতেই ছিল। কম যান নি তাঁর সহ অভিনেতা জ্যারেড লেটো। রনের ট্রান্সসেক্সুয়াল ব্যাবসায়িক পার্টনার রেয়নের চরিত্রে তাঁর অভিনয় ছিল অনবদ্য। তাঁর ঝুলিতেও জুটে গেছে সেরা সহ অভিনেতার অস্কারটি।

পরিচালকের কিছু কিছু ভুল অবশ্য লক্ষ্যণীয় ছিল। রনের চরিত্রের বিবর্তন দেখাতে গিয়ে হঠাৎ তাঁকে আন্তর্জাতিক ড্রাগ স্মাগলারের ভূমিকার পর্যায়ে পৌছে দেওয়ার পরিবর্তনটা ছিল অপ্রত্যাশিত এবং খানিকতা বেখাপ্পা। জেনিফার গার্নারের চরিত্রটাকেও বেশ জায়গা ছাড়া হয়েছে যা আসলে ছবির মূল প্রেক্ষাপটের সাথে অনেকজায়গাতেই অপ্রয়োজনীয় ছিল। পরিচালক ডকুমেন্টারির আদলে ছবিটি তৈরী করতে গিয়ে অনেক তথ্য সরবরাহ করেছেন বটে, কিন্তু কাহিনীর বেড়াজালে শেষ পর্যন্ত একজন সাধারণ দর্শকের জন্য তথ্যগুলোর সুতো জোড়া লাগানোটা বেশ শক্তই ছিল বলা যায়। তবে ছোটখাট এসব ত্রুটিকে আমলে না নিয়ে চমৎকার এবং অনেক বেশী বাস্তব আর জান্তব একটি চলচ্চিত্র উপহার দেওয়ার জন্য পরিচালক, বিশেষ করে কলাকুশলীরা বাহবা পাওয়ার দাবীদার। সম্ভবত সমালোচকদেরও ধারনা একইরকম, এ কারণেই এবারের অস্কারের সেরা চলচ্চিত্র বিভাগে অন্যদের থেকে বেশ এগিয়েই ছিল ডালাস বায়ারস ক্লাব। তবে শেষ পর্যন্ত অস্কারের শিকে আর ছেঁড়া হয় নি এই যা!

0 মন্তব্য(গুলি):