পরিচালক ওয়েস অ্যান্ডারসনের মুনরাইজ কিংডম দেখার পর যদি ও ধরনের মুভি দেখার আশা নিয়ে দা গ্র্যান্ড বুদাপেস্ট হোটেল দেখতে বসেন তবে বড় রকমের ...

গ্রান্ড বুদাপেস্ট হোটেলে কিছু সময়...


পরিচালক ওয়েস অ্যান্ডারসনের মুনরাইজ কিংডম দেখার পর যদি ও ধরনের মুভি দেখার আশা নিয়ে দা গ্র্যান্ড বুদাপেস্ট হোটেল দেখতে বসেন তবে বড় রকমের ধাক্কা খেতে আপনি বাধ্য। কারণ এই চলচ্চিত্র সাধারণ-অসাধারণ সকল দর্শকের জন্য।


রহস্য-রোমাঞ্চ, খুন জখম, গাড়ি দৌড় সব ধরনের আকর্ষণ, সেই সাথে এক ঝাঁক হলিউডি তারকার সমাবেশ। ১৯৩২, ১৯৬৫ এবং ১৯৮৫ - তিনটি সময়রেখা ধরে এই ছবির কাহিনী এগিয়েছে সমান্তরালে। তবে যাঁরা অ্যান্ডারসনের কাজ দেখে অভ্যস্ত তারা হয়তো একটু অবাকই হবেন এ ছবির ক্যামেরার কাজ, গতিবিধি দেখে। অনেকই নিঝুঁত, সত্যি বলতে কি বেশ জড়তাই আছে ক্যামেরার নাড়াচাড়ায় - যেন পরিচালক ভয়ে ছিলেন সামান্যতম বিচ্যুতিতে নড়ে যাবে তাঁর গ্রান্ড বুদাপেস্ট হোটেল।

কিছু এলোমেলো শট দেখাবার পর পরিচালক অ্যাণ্ডারসন দর্শকদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন কাহিনীর প্রধান চরিত্র গুস্তাফের(রালফ ফিয়েন্স) সাথে। যুদ্ধের প্রাক্কালে ইউরোপের এক কাল্পনিক রাষ্ট্র যুব্রাওকা প্রজাতন্ত্রের পাহাড়ের চুড়ায় সগৌরবে দাঁড়িয়ে থাকা এক বিখ্যাত পাঁচ তারা হোটেলের কনসিয়ের্জের দায়িত্বে আছেন গুস্তাফ। তাঁর কাজ হোটেলের বাসিন্দা বিত্তশালী বৃদ্ধাদের দেখাশোনা করা এবং লবি বয় জিরোকে(টনি রেভোলোরি)কে বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান দান করা। এই হোটেলেরই বাসিন্দা শতবর্ষী বৃদ্ধা মারা যাওয়ার আগে এক অদ্ভুত পেইন্টিং দিয়ে যান তাঁর স্নেহধন্য গুস্তাফকে। এই ছবির ওয়ারিশ নিয়েই ঘোট বাঁধে বৃদ্ধার পুত্র এবং সাংপাঙ্গের সাথে আমাদের গুস্তাফ এবং জিরোর এবং শুরু হয় দৌড়ঝাঁপ, গোলাগুলির রংতামাশা।

ঘুরে ফিরে অনেক পরিচিত মুখকেই টেনে এনেছেন পরিচালক গ্রায়ন্ড বুদাপেস্ট হোটেলে। বিল মারে, ওয়েন উইলসনের চেহারা হয়তো দেখতে পাবেন খানিক্ষণের জন্য, আবার এড্রিয়ান ব্রডি, টিল্ডা সুইনটন, জেফ গোল্ডব্লাম, এডওয়ার্ড নর্টনের মতো সুপরিচিত চেহারাগুলো দেখা যাবে বেশ ব্যাপ্তি জুড়েই।

তিনটি টাইমলাইনে সমান্তরালে চলা এই চলচ্চিত্রে অনেকগুলো চমৎকার চরিত্রের আনাগোনা দেখা যাবে। মারে আব্রাহামের সাথে তরুণ লেখকের বিষন্ন কথোপকথন, গুস্তাফ আর জিরোর রোমাঞ্চকর দিনগুলির স্মৃতি রোমন্থন। তরুণ, সঙ্গীহীন লেখকের চরিত্রে জুড ল, ষাটের দশকে যিনি গুস্তাফ আর জিরোর সান্নিধ্যে ছিলেন। সম্পত্তির লড়াইয়ের জের ধরে আরো কিছু দারুণ চরিত্রের আবির্ভাব দেখা যাবে,  একজন ভোলাভালা বেকারির মালিক(সারইজ রোনান), নীতিতে অবিচল মিলিটারি অফিসার আলবার্ট হাঙ্কেলস(এডওয়ার্ড নর্টন), প্র্যাত কাউন্টেসের সম্পত্তি প্রত্যাশী পুত্র দিমিত্রি(এড্রিয়ান ব্রডি) এবং তার ব্যক্তিগত ডিটেকটিভ ওরফে ভাড়াতে গুন্ডার চরিত্রে উইলিয়াম ডাফো।

অনেক তারকার ভীড়েও র‍্যালফ ফিয়েনসের প্রধান চরিত্রটি কখনোই তিনি ম্লান হতে দেন নি। হ্যারি পটার যুগের র‍্যালফ যেন আবার তাঁর ইংলিশ পেশেন্ট, শিন্ডলার্স লিস্টের যুগে ফিরে গিয়েছিলেন। চমৎকার সংলাপ নিক্ষেপণ আর কমিক টাইমিং দিয়ে গুস্তাফ চরিত্রটিকে আপন করে নিয়েছেন রালফ। বিশেষ করে সময়ে সময়ে গুস্তাফ চরিত্রটির রূপবদল, বিভিন্ন চরিত্রের সাথে কথোপকথনের সময় তার অভিব্যক্তি এবং বাচনভঙ্গীর পরিবর্তন নজর কাড়ার মতো ছিল। তাঁর সাথে টনি রেভোলোরির চরিত্রের রসায়ন ছিল ছবির অন্যতম আকর্ষণীয় দিক । এছাড়াও নেগেটিভ চরিত্র ব্রডি এবং ডাফোর অভিনয়ও ছিল মনে দাগ কাটার মতন।

বিখ্যাত কম্পোজার আলেক্সান্দার দেসপ্লার সুরের মায়াজাল আর “মুনরাইজ কিংডম”খ্যাত চিত্রগ্রাহক রবার্ট ইয়োম্যানের নিপুণ ছোঁয়া ছবির ক্লাসিক চিত্রপটের রংটা যেন আরো খোলতাই করেছে।

একই ছবির মাঝে কমেডি, ট্রাগেডি, নস্টালজিয়া আবার দুই বিশ্বযুদ্ধের মধ্যকার সময়কার গোলযোগ, ইউরোপের জাঁকজমক, অ্যাকশন, ড্রামা সবকিছু ঢুকালেও জিনিসটা আর যাই হোক খিচুড়ি হয় নি এখানটাতেই পরিচালকের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব। গ্র্যান্ড বুদাপেস্ট হোটেল আমাদের দেখায় যে সমাজে টিকে থাকার জন্য কেন আমাদের বারবার ভেক ধরতে হয়, নিজেকে উপস্থাপন করতে হয় মুখোশের অন্তরাল থেকে। কিন্তু মুখোশের আড়ালের কদাকার চেহারা বের করে আনে ষড় রিপুর মাঝে সবচেয়ে ভয়ানক রিপুঃ লোভ। অ্যান্ডারসন দেখিয়েছেন এই সাজানো গোছানো সমাজের প্রায় গোটাটাই ধোঁকা, আর সত্যগুলো আরো কঠিন, রংচটা।

0 মন্তব্য(গুলি):