আসাদ গোটা চিঠিটা আরো একবার পড়ল, প্রতিটা শব্দ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। পড়া শেষ করে সে সুন্দর করে কাগজটাকে ভাঁজ করে যত্ন করে খাকি খামটার ভেতর ঢুকি...

চিঠি

আসাদ গোটা চিঠিটা আরো একবার পড়ল, প্রতিটা শব্দ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। পড়া শেষ করে সে সুন্দর করে কাগজটাকে ভাঁজ করে যত্ন করে খাকি খামটার ভেতর ঢুকিয়ে রাখলো। টেবিলে অবহেলায় পড়ে থাকা একটা ন্যাতানো গোল্ডলীফে আগুন ধরিয়ে ফুসফুস বিদীর্ণ করা এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে আসাদ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল, এই জীবন রাখার আর কোন অর্থ নেই। 

 




এ ধরনের ধ্বংসাত্বক সিদ্ধান্ত নেওয়ার পেছনে অবশ্য কেবল এই একটা চিঠিকে দায়ী করলে বেশী জুলুম হয়ে যাবে। আসাদের গোটা জীবনটাকে যদি খাতা কলমে লিখে রাখা হতো তবে খুব সহজেই সেটাকে হতাশার অভিধান হিসেবে চড়া দামে বাজারে বিক্রী করা যেতো, হয়তো সেক্ষেত্রে আসাদের হতাশা খানিকটা কমতোও বটে! আসাদরা চার ভাইবোন, আসাদ তৃতীয়। তার ভাইবোনেরা সবাই কৃতী ছাত্র-ছাত্রী, ভালো বিতার্কিক, তাক লাগানো ফুটবলার অথবা মারদাঙ্গা ক্রিকেটার। এমনটা নয় যে আসাদ খারাপ ছাত্র - সেও প্রায় নিয়মিতই স্কুলে ফার্স্ট-সেকেন্ড হয়ে এসেছে কিন্তু কোন এক রহস্যজনক কারণে স্কুলের কোন স্যার বা ম্যডামই তাকে মনে রাখতে পারতেন না। ফার্স্ট বয় হয়েও ক্লাস ক্যাপ্টেনের তকমাটা কেন যেন কখনো তার গায়ে লাগে নি। আসাদের ফুটবল খেলতে খুবই ভাল লাগতো এবং খেলতোও সে ভাল। স্কুলে প্রথম ম্যাচে দুই বছরের অগ্রজদের দলকে শুরুতেই তিন গোল দিয়ে দেওয়ার পর ষন্ডা ষন্ডা তিনজন বড় ভাই একসাথে ট্যাকল করে তাকে কোমরভাঙ্গা “দ” করে ছেড়ে দেয়। ঐ পা ভাঙ্গার পর থেকেই তার যাবতীয় খেলাধুলা আর স্বাভাবিকভাবে হাঁটাচলার ইতি। কলেজে প্রথম ক্লাসে স্যারের ডাকে যখন আসাদ সিট ছেড়ে স্যারের ডেস্কের সামনে দাঁড়াল তখনো সে জানে না যে তার বেঞ্চে মাথা উঁচু করে থাকা এক বিপ্লবী ঘাড়ত্যাড়া পেরেকের আক্রমণে তার প্যান্টের পেছন দিকটা হরতালের রাস্তাঘাটের মতোই খোলামেলা হয়ে গেছে। স্যারের প্রশ্নের উত্তরে যখন আসাদ বলল,”জ্বী, আমার বাড়ি গোয়ালন্দ।” তখন ক্লাসের সবার সমস্বরে হাসির রহস্যও তখন সে ধরতে পারে নি। সঙ্গতকারণেই কলেজে খুব একটা বন্ধুবান্ধব জোটানোর সুযোগ হয় নি, সত্যি বলতে কি আসাদ ক্লাসেই গিয়েছে এরপর অল্প কিছুদিন। ভার্সিটিতে প্রথমবারের মতো কিছু বন্ধুবান্ধব জুটেছিল অবশ্য। একটা মেয়েকেও ভালবাসতে শুরু করেছিল সে। এক বসন্তের দিনে মেয়েটাকে তার মনের কথা জানানোরও চিন্তাভাবনা করেছিল। কে জানতো সেই মেয়েকেই তার বড় ভাই বিয়ে করে ঘরে তুলবে এবং সারাজীবন ভাবী ডাকতে গিয়ে বারংবার অপমানের সুক্ষ্ণ ও স্থুল খোঁচা খেতে খেতে এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে যেতে হবে? ও কারণেই আজীবনের আবাস, শেখেরটেকের বাড়িখানা ছেড়ে এই সভ্যতা ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার ছোঁয়া বিবর্জিত এক রুমের- না ফ্ল্যাট বললে ফ্ল্যাট জাতির, এবং তাদের সুদূর আত্মীয়স্বজনও অপমানবোধ করবে… দু’রুমের এই ম্যাচবাক্স বা মতান্তরে মেসবাড়িতে এসে আবাস গড়তে হয়েছে।

যাহোক, সিদ্ধান্তটা নেওয়ার পর আসাদের মেজাজ বেশ ফুরফুরে হয়ে উঠল। এমনকি বাসী গোল্ডলীফের তিতকুটে স্বাদের কথাও সে ভুলে গেল মুহূর্তের জন্য। সিদ্ধান্ত নেওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল, এখন কাজে নেমে পড়তে হবে- না, তার আগে ভালমতন আঁটঘাট বেঁধে কিছু প্ল্যান প্রোগ্রাম করা দরকার। আচ্ছা, কীভাবে হলে সবচেয়ে ভাল হয়? সাথে সাথেই তার সবচেয়ে জনপ্রিয় আর ঐতিহ্যবাহী পদ্ধতিটা মাথায় এলো - ফ্যানে দড়ি লাগিয়ে ঝুলে পড়া। কিন্তু সমস্যা হল - গতমাসে বাড়িভাড়া বাকি পড়ায় সিলিং ফ্যানটা বেচে দিতে হয়েছে। এক বন্ধু ফ্যানটা নিয়ে গেছে এবং প্রতিশ্রুতি দিয়ে গিয়েছিল পরেরদিনই সে টাকা দিয়ে যাবে। ব্যাটা এখন ফোনই ধরে না, আসাদের অতীত ইতিহাস বিবেচনা করলে ঐ টাকার আশা ছেড়ে দেওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। তাহলে এই প্ল্যান বাদ, আর কী হতে পারে? বিষ খাওয়া যেতে পারে- খারাপ না ব্যাপারটা। তবে অবশ্য বেশ মেয়েলী হয়ে যায়। তাছাড়া আজকালকার ওষুধপত্রেই যে পরিমাণ ভেজাল, বিষে যে ভেজাল থাকবে না তার নিশ্চয়তাই বা কে দিবে? দেখা গেল মরার বদলে পেট খারাপ হয়ে চিৎপাত হয়ে জামাকাপড় নষ্ট করছে সে। যেহেতু আশেপাশে দেখাশোনা করার মানুষও নেই, তাই শেষমেশ হয়তো পেট খারাপ করেই পটল তুলতে হবে। জান যাওয়ার লক্ষ্য পূর্ণ হবে কিন্তু বাড়তি হিসেবে মান-ইজ্জতেরও কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না। যদিও মরার পর আর মান-ইজ্জত নিয়ে খামোখা টেনশন করার কোন মানে হয় না তবুও জীবনের শেষ কীর্তিটাই যদি গু-মুত মাখানো হয় তবে ব্যাপারটা কেমন যেন ঠিক ঠেকে না। হলিউডি মুভির মতন মুখের ভেতর পিস্তল ধরে গুলি করলে কেমন হয়? চিন্তা করেই বেশ রোমাঞ্চ বোধ করে আসাদ, মনে মনে দৃশ্যটা কল্পনাও করে নেয় সে। বাথরুমের পারা ওঠা অস্পষ্ট আয়নাটার সামনে দাঁড়িয়ে পিস্তলটা মুখের ভেতর নিয়ে- ব্যাস! চারদিকে বেশ একটা রক্তাক্ত পোস্ট মডার্ন আর্টের সিন তৈরী হবে বৈকী। তবে এই রোমাঞ্চের বুদবুদের স্থায়িত্ব ছিল বড়জোর সেকেন্ড তিনেক, পিস্তল জোগাড় করার হ্যাপার কথা আসাদের মাথাতেই আসে নি। পিস্তল জোগাড় করতে গিয়ে দেখা যাবে পুলিশের বা এলাকার “বড় ভাইদের” প্যাদানি খেয়ে বিছানায় শুয়ে কাতরাতে হবে। নাঃ কোন পদ্ধতিই তো মনপুতঃ হচ্ছে না, শালার এই দুনিয়ায় জীবনের ইতি টানতে এত সাত পাঁচ ভাবতে হবে তা কে জানতো? আচ্ছা... তাহলে ছাদ থেকে লাফ দিলে কেমন হয়? - এটা হতে পারে। ঢাকা শহরে গগনচুম্বী দালানের অভাব নেই, মোটামুটি নার্ভ শক্ত রেখে লাফ দিতে পারলেই হল, আর দেখতে হবে না। আসাদের ভার্সিটির নতুন বিল্ডিংটা বেশ লম্বা চওড়া। ওখান থেকে লাফ দিলে নিচের কংক্রীটে পড়ার আগেই ভয়ে জান আজরাইলের কামিজের পকেটে চলে যাবে। তাছাড়া ভার্সিটির পোলাপান হয়তো এক আধদিন ছুটি পেয়ে দোয়া-টোয়া করে জাহান্নামের আগুনের আঁচ কমানোর একটা সিস্টেমও করে দিতে পারে। রিমি, আসাদের অতীতের ভালোবাসা বর্ত্তমানের ভাবী এখনো সেখানে শেষ সেমিস্টারে পড়ছে, তার ক্লাসের ছুটির সময় দেখে কাজটা করলে মন্দ হয় না। ভেবেই আসাদ খুব মজা পায়। কিছুক্ষণ হেসে নেয় তার তরমুজভর্তা হয়ে যাওয়া দেহ দর্শনে রিমির প্রতিক্রিয়ার কথা ভেবে। হ্যা, এটাই সবচেয়ে ভালো উপায়।

এরপর? এরপরের ধাপটা অবশ্য খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ না। চিঠি, সুইসাইড নোট - বিশ্ববাসীকে জানিয়ে যাওয়া কেন তাদেরকে ছেড়ে অজানার উদ্দেশ্যে পা বাড়াচ্ছে আসাদ। ব্যক্তিগতভাবে জিনিসটাকে ন্যাকামি ছাড়া আসাদ আর কিছুই মনে করে না। আরে বাবা, একে তো আত্মহত্যা করে জীবনের কাছে পরাজয় স্বীকার করে নরকে যাওয়ার নিশ্চিত টিকেট কাটছি, সেটা আবার ঘটা করে দুনিয়াবাসীকে জানানোর কি দরকার? তার ওপর মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে বলা যায় যে সেটা প্রথমে পড়বে তাদের মেসের বুয়া, তারপর বাড়িওয়ালা থেকে শুরু করে পুলিশ, সাংবাদিক এবং তাদের কল্যাণে হয়তো গোটা দেশবাসী। কোন মানে হয় এসব প্রহসনের?

এসব ছাইপাঁশ চিন্তা করতে করতে আবারো টেবিলে হেলায় ফেলে রাখা খাকি খামটা চোখে পড়ল আসাদের। আপনা থেকেই তাচ্ছিল্যের একটা হাসি বের হয়ে এলো বহু বছরের জমানো দীর্ঘশ্বাসকে ঝেঁটিয়ে। এই চিঠিটাই সম্ভবত আসাদের অগুরুত্বপূর্ণ, ছোট জীবনটার ব্যর্থতার সর্বশেষ নিদর্শন হতে যাচ্ছে। ঘরের কোণায় লুকিয়ে থাকা মাকড়সার মতো এগিয়ে গেল আসাদের ফ্যাকাশে হাত, অসাড় আঙ্গুলগুলো বের করে আনল খামের ভেতরের চিঠিটাকে। ষষ্ঠবারের মতো চোখ বুলিয়ে গেল,এফোর কাগজে ছোট ছোট ফন্টে প্রিন্ট করা গুটি গুটি অক্ষরগুলোর ওপর। “অপরিপক্ক লেখনী”, “ঝুঁকি”, “নব্য লেখক”, “সম্বব হচ্ছে না”, “চেষ্টা করতে থাকুন” জাতীয় কিছু বাক্যাংশ আরো একবার গায়ে বিছুটিপাতার জ্বালা ধরিয়ে গেল। চিঠিটা পড়া শেষ করে দীর্ঘ সময় ব্যয় করে আসাদ কাগজটাকে যত্ন করে ছিঁড়ে কুটিকুটি করল।

অনেক দিন ধরেই লেখালেখির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে আসাদ। ছোটবেলায় বই পড়া এবং লেখালেখির এই নেশাই তাকে নিঃসঙ্গতা থেকে অনেকটা রক্ষা করেছে। বড় হয়েও এই নেশা কমে নি। পত্র পত্রিকায় বেনামে স্বনামে ম্যালা লেখা পাঠিয়েছে সে, ছাপার অক্ষরে নিজের লেখা দেখাটা আসাদের জীবনের একটিমাত্র কাজ যেটাকে সে সাফল্য হিসেবে গণ্য করে। তার যেহেতু খুব একটা বন্ধুবান্ধব নেই, লেখা পড়ে আহা উহু করবার মানুষ আসাদ পায় না। তার লেখার অবশ্য একজন একনিষ্ঠ পাঠক এবং ভক্ত আছে, সেটা তার ছাত্র রবিন। রবিনকে সে ক্লাস সিক্স থেকে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা পর্যন্ত টিউশনি করিয়েছে। সত্যি বলতে কি আসাদের নিজের পরিবারের তুলনায় রবিনের পরিবারের সাথে তার হৃদ্যতার মাত্রাটা বেশি। রবিন ছেলেটা পড়াশোনায় ভাল কিন্তু বেশ বোকাসোকা আর সহজ সরল। আসাদকে সে খুবই পছন্দ করে, আসাদ সেটা ভাল মতই টের পায়। আসাদ নিজেও রবিনকে মনে মনে ছোটভাইয়ের মতই ভালবাসে কিন্তু কখনো প্রকাশ করে না তেমনভাবে। ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার পরও অন্তত সপ্তাহে একবার করে হলেও রবিন তার সাথে আড্ডা মেরে যায়। এই হাবাটাই তাকে প্রথম লোভ দেখিয়েছিল বই লেখার, ছাপানোর বন্দোবস্ত নাকি সে-ই করবে। রবিনের সামনে ব্যাপারটা হেসে উড়িয়ে দিলেও ঐ যে আসাদের মাথায় বই লেখার পোকাটা ঢুকেছিল, সেটার কুড়কুড়ানিতে অস্থির হয়ে শেষ পর্যন্ত লেখা শুরু করে আসাদ। সেই লেখা শেষও হয় একসময়। এর পর থেকেই আবার তার ব্যর্থতার অভিধানে পৃষ্ঠা যোগ হতে থাকে। বহুত প্রকাশকদের আছে ধর্না দিয়ে চিঠি পাঠিয়েও সে কারো মন গলাতে পারে নি। এক আধবার মনে হয়েছিল অবশ্য রবিনকে বলে দেখার কথা, ছেলেটার এক চাচা বড় একটা পাবলিকেশনসের কর্ণধার। ঝামেলা হল, ছেঁড়া জামা গায়ের আসাদের আত্মসম্মানবোধটাই শুধুমাত্র অটুট। কাজেই মুখ ফুটে নিজের ছাত্রের কাছে সাহায্য চাওয়াটা আর হয়ে ওঠে নি। রবিন অবশ্য আঁচ করেছিল যে আসাদ বই লেখা শুরু করেছে, অনেক অনুরোধও করেছিল কিন্তু আসাদ বরাবরই অস্বীকার করে গিয়েছে। এর মাঝে একবার আসাদের অনুপস্থিতিতে রবিন তার মেসে এসে পান্ডুলিপির খানাতল্লাশিও চালিয়ে গিয়েছে, সে সময় ঐ খাতাটা আসাদের ব্যাগে করে বাসে ঝুলছিল বলে সেটার সুলুক সন্ধান করতে পারে নি রবিন। ব্যাপারটা জানতে পেরে আসাদ বেশ কড়া ভাষায় রবিনকে ধমকেছে, তার কর্কশ ভাষায় খুবই আহত হয়েছিল রবিন, সহজ সরল ছেলে - ঠোঁট দাঁতে কামড়ে দু’ফোঁটা অশ্রুও দান করে গিয়েছিল আসাদের ধুলো ধুসরিত মেসের মেঝেকে। আসাদ টলে নি, বের করে দিয়েছিল রবিনকে। এর পর থেকে রবিন আর আসে না।

আসাদ একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। চায়ের তৃষ্ণা পেয়েছে, চুলার কাছে যেতেই মনে পড়ে গ্যাসের লাইন বন্ধ বেশ কয়েকদিন ধরে, বাড়িওয়ালা গা করছেনা খুব একটা। আসাদের চোখ পড়ে তার সদ্য ৩২তম বারের মতো রিজেকশন খাওয়া পান্ডুলিপিটার দিকে, এক তাড়া অপ্রয়োজনীয় কাগজ মনে হয় ওগুলোকে। নির্বিকারভাবে পান্ডুলিপিতে আগুন ধরিয়ে চুলায় চা বসায় আসাদ।

চা নিয়ে আসাদ টেবিলে বসে একটা সাদা খাতা থেকে একটা পাতা ছিঁড়ে নেয়। তারপর সেখানে লেখানে লেখে - “আমার মৃত্যুর জন্য দায়ী সবাই”। এই পাঁচটা শব্দ বিভিন্ন ভাবে, বিভিন্ন সুরে পড়ে আসাদ, যেভাবে ছেলেবেলায় নামতা পড়তো। নাঃ ভাল ঠেকছে না। কেমন যেন গা ছাড়া ভাব, মনে হচ্ছে লেখক তার সারা জীবনের মতো মৃত্যুকেও কখনো সিরিয়াসলি নেয় নি। না এভাবে হবে না, জীবন যত খারাপই হোক না কেন লেখক হিসেবে তার একটা দায় আছে সবার প্রতি। চায়ে চুমুক দিয়ে পাতাটা দুমড়ে ছুঁড়ে দেয় আসাদ টেবিলের ওপাশে ময়লার ঝুড়িতে। গোটা খাতাটাই টেনে নেয় এবার। চিঠি লেখা শুরু করে আসাদ। সে চিঠি লেখে তার মৃত মা-বাবাকে, প্রতিটি ভাই বোনের জন্য আলাদা আলাদা করে চিঠি লেখে সে। চিঠি লেখে সে রবিনের জন্য। আসাদ চিঠি লেখে রিমির উদ্দেশ্যে। মন প্রাণ ঢেলে দিয়ে চিঠি লিখতে থাকে আসাদ। কোন চিঠিতেই কোন সম্বোধন নেই, নেই কোন নাম ঠিকানা - আসাদ শুধু লিখেই যায়। দু’তিন, তিনদিন, সাতদিন ধরে আসাদ চিঠি লিখতে থাকে। সে চিঠি লেখে তার ছোটবেলায় ফ্রি আইসক্রিম খাওয়ানো আইসক্রিমওয়ালা চাচাকে। সে চিঠি লেখে তার প্রাইমারি স্কুলের বাংলার শিক্ষক মধুসুদন স্যারকে। চিঠি লেখে তাকে পুরো স্কুলজীবন জ্বালাতন করা কবিরকে, চিঠি লেখে সে একটা গোটা মিছিলকে উদ্দেশ্য করে - যে মিছিলে প্রধমবার ফুসফুসে জ্বালা ধরিয়ে শ্লোগান দিয়েছিল আসাদ। আটদিন, দশ দিন পেরিয়ে যায়… নাওয়া খাওয়া ভুলে আসাদ লিখতেই থাকে, পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা ভরে যায় তার হস্তাক্ষরে, কলমের কালি ফুরায়, ছুঁড়ে ফেলে আবার নতুন কলমে লেখা ধরে। ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার পর রবিন তাকে একটা দামী কলমের সেট দিয়েছিল, সেগুলোর আয়ু ফুরোতে থাকে মঙ্গা আক্রান্ত গ্রামবাসীদের মতো। সে চিঠি লেখে তার গ্রামের বাড়ির নিস্তরঙ্গ দিঘিকে, চিঠি লেখে তার মেস বাড়ির ঘুলঘুলিতে সংসার বাঁধা চড়ুই পাখিদের। সে চিঠি লেখে সেই রিকশাওয়ালা চাচাকে যে আসাদের রিকশায় ফেলে আসা ব্যাগ ফেরত দিতে এসেছিল তার মেসে, চিঠি লেখা হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের উদ্দেশ্য করে, সেখানে থাকে না কোন গালিগালাজ। এমনকি প্রাধানমন্ত্রীকেও একটা চিঠি দেয় আসাদ, তবে সেখানে কোন দাবী দাওয়ার কথা থাকে না। ১৭ দিন ধরে সে টানা লিখে যায়, এক বিকেলে তার মোটা খাতাটার শেষ পাতায় শেষ চিঠিটার শেষ অক্ষরটি লেখে সে। অনেক্ষণ চুপচাপ চেয়ারে বসে থাকে ঝিম মেরে। সিগারেটের সাপ্লাই শেষ অসংখ্য মৃত সিগারেটের লাশ স্তুপ হয়ে পড়ে আছে টেবিলের চারপাশে। আসাদ ঘর ছেড়ে বের হয়।

এতদিন বন্দী জীবন যাপন করার কারণে শেষ বিকেলের নরম আলোও চোখ ধাঁধিয়ে দেয় আসাদের। সে উদ্দেশ্যহীন ভাবে রাস্তায় হাঁটে, মাঝে মাঝে কোন একটা টংএ দাঁড়ায়, চা সিগারেট খায়, আবারো হাঁটে । আকাশের সীমানার ওপারে আসাদকে ফেলে হারিয়ে যায় রক্তিম সূর্যটা, সন্ধ্যা নামে, রাস্তায় বাড়ে লোকজনের ব্যস্ততা। তার মাঝেই হাঁটে আসাদ, তার মাথা আজকে অস্বাভাবিক ফাঁকা, সেখানে কোন চিন্তাই খেলা করে না। তার সামনে একটা বাইক হুমড়ি খেয়ে পড়ে, হেঁটে যায় উগ্রসাজের কিছু রমণী - তাদের কলতানে মৌ মৌ করে চারপাশ। কোন কিছুই তাকে স্পর্শ করে না, আসাদ শুধুই হাঁটে।

গভীর রাতে ঘরে ফেরে আসাদ। দেখে দরজা হাট করে খোলা। ভেতরে ঢুকে দেখে সব ফকফকা, কেউ এসে ঘর সাফ করে সব তার ইহজাগতিক সকল সম্পত্তি চেঁছেপুঁছে নিয়ে গিয়েছে। ছোট একটা রেডিও, কমদামী মোবাইল সেট, তার বইপত্র, থালা বাসন এবং- এবং আসাদের টেবিলে রাখা কলমের সেট আর তার চিঠি লেখা খাতা। আসাদের কোন ভাবান্তর হয়না এত বড় একটা ঘটনায়। ওলটানো ময়লার ঝুড়িটা সে সোজা করে রাখে। নিচু হতে গিয়ে টেবিলের নিচে পড়ে থাকা একটা দোমড়ানো কাগজের দলা চোখে পড়ে। কুড়িয়ে নিয়ে ভাজ সমান করে সেটার ওপ চোখ বোলায় আসাদ। মুখে হাসি ফোটে তার, কাগজটা যত্ন করে ভাঁজ করে বুকপকেটে রাখে। তার কেন যেন প্রচন্ড হাসি পায়, হা হা করে সশব্দে হাসতে থাকে সে। আশেপাশের রুম থেকে মানুষ বেড়িয়ে আসে, লোক জড়ো হয়ে যায়, তাও আসাদ হাসতেই থাকে।

প্রকাশক আজাদ সাহেব মনোযোগ দিয়ে পড়ছেন পান্ডুলিপিটা। তাঁর ভাতিজা রবিন এই খাতাটা এনে দিয়েছে গতকাল। নিঃসন্তান আজাদ সাহেব প্রচন্ড রকমের স্নেহ করেন বোকাসোকা রবিনকে, তাই তার অনুরোধ ফেলতে পারেন নি। রবিন বলেছে আগামীকালকেই সে আসাদকে নিয়ে আসবে তাঁর অফিসে। বোকা ছেলেটা গোপনে তার স্যারের খাতাপত্র, বিছানাবালিশ নিয়ে গিয়েছে তার নিজের বাসায়, স্যার কে জোর করে নিজের বাসায় ওঠাবে এই তার মতলব। আজাদ সাহেবের ছোটভাই রফিক আর রফিকের বউ মিলিরও কোন আপত্তি নেই, তারাও নাকি আসাদ ছেলেটাকে নিজেদের ছেলের মতোই দেখে। বেশ খানিকটা কৌতুহল নিয়ে আজাদ সাহেব পান্ডুলিপিটা পড়া শুরু করেছিলেন, এখন তাঁর মনে হচ্ছে সিদ্ধান্তটা নেওয়ার জন্য নিজেই নিজের পিঠ চাপড়ে দেওয়া উচিত। পরিষ্কার টানা হাতের লেখায় লেখা প্রতিটা চিঠিই চমৎকার, এক একটা চিঠিতে জীবনের একেক রকম দৃষ্টিভঙ্গী ফুটে উঠেছে, লেখকের অন্তর নিংড়ানো কথাগুলো মনে দাগ কেটে যায়। কোন চিঠি পড়ে বেজায় হাসি পায় আবার কোনটা যন্ত্রনার বেহালায় সুর তোলে। এক মনে পাতা উল্টোতে থাকেন তিনি, মনে মনে ভাবেন এই আসাদ আহমদ ছেলেটাকে একটা সুযোগ দিয়ে দেখা যায়। তাঁর এত বছরের প্রকাশনা জীবনের অভিজ্ঞতা বলছে এই লেখা পাবলিক খাবে। আবারো পান্ডুলিপিটা প্রথম থেকে পড়া শুরু করেন আজাদ সাহেব। টেলিভিশনের আওয়াজ তার মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটায়। টিভিতে এক ভোটকা, গুঁফো সাংবাদিক চেঁচিয়ে যাচ্ছে… ভার্সিটির ছাদ থেকে লাফ দিয়ে এক ছেলে আত্মহত্যা করেছে, এ নিয়ে বিশাল শোরগোল, প্রচুর টিভি ক্যামেরা, সাংবাদিক ইত্যাদি ইত্যাদি - আজকাল যা হয় আর কি। ভোটকা সাংবাদিক আঞ্চলিক টানে নাকি সুরে জানাল, ছেলেটার বুক পকেটে একটা চিরকুট পাওয়া গেছে - সেখানে লেখা “আমার মৃত্যুর জন্য দায়ী সবাই”...

“আজকালকার পোলাপান!” স্বগতোক্তি করেন বিরক্ত আজাদ সাহেব। রিমোট চেপে টিভি বন্ধ করে মন দেন আসাদের পান্ডুলিপির প্রথম চিঠিতে।

৪টি মন্তব্য:

  1. এইটা কি নতুন লিখছস? আগে পড়ছি মনে হচ্ছে।

    উত্তরমুছুন
  2. লেখার শুরুর অংশে একটু খাপছাড়া ভাব ছিল, কিন্তু লেখা যত এগিয়েছে ততই গতিময়তা এবং ধরে রাখার একটা শক্তি তৈরি হয়েছে। অনেকদিন পরে কাছের মানুষের একটা ভাললেখা পড়তে পেরে বেশ আরামবোধ করলাম। ধন্যবাদ ফুয়াদ।

    উত্তরমুছুন
  3. অনেক দিন পর তোর লেখা পড়লাম।

    উত্তরমুছুন