পানিতে পড়বার সাথে সাথেই একটা গগনবিদারী চীৎকার দেওয়া আমার মতো সন্তরণবিদ্যায় অজ্ঞ বান্দাদের জন্য একটি ফরয কাজ। তবে এক্ষেত্রে ইচ্ছেটাকে বাস্তবে পরিণত করতে গিয়ে এক পেট মিনারেল ওয়াটার খাওয়া ছাড়া আর কোন লাভ হল না। পানির গভীরতা বেশি নয়, তবে স্রোত প্রচন্ড। পানিতে পড়বার সাথে সাথেই দেখেছিলাম পনের কি বিশ ফুট সামনে একটা শক্তসমর্থ লতা যেন আমাকে উদ্ধার করবার জন্যই মাথা হেঁট করে আছে। তবে স্রোতের গতির কারণে চোখের পলকে ঐ দূরত্ব অতিক্রম করলাম এবং পরম করুণাময় সৃষ্টিকর্তার মেহেরবানিতে লতাটা হাতে এল। ঘ্যাঁচ ঘ্যাঁচ করে হাতের তালুতে পাঁচ ছয়টি কাঁটা ফুঁটল, আমার উদ্ধারকর্তা লতাগাছটি যে একজন নির্মম কাঁটালতা তা কে জানতো? যাকগে, কোনমতে হাঁচড়ে পাঁচড়ে নিজের আজদাহা শরীরখানা পানি থেকে উঠালাম। হৃদপিন্ড বাবাজি যে হারে বুকে দুরমুশ পিটে চলছেন তা ইতালির বিখ্যাত পেড্রোলো পাম্পকেও লজ্জা পাইয়ে দেবে। পাগলা কুকুরের মতো হ্যা হ্যা করে কিছুক্ষণ প্রাণভরে শ্বাস নিলাম, মস্তিষ্কে অক্সিজেনের সাপ্লাই যেতেই আশেপাশের দৃশ্যপট পরিষ্কার হতে শুরু করল। সামনে যা দেখলাম তাতে করে আমার প্রাণপ্রিয় আত্মারামের খাঁচাছাড়া হওয়ার উপক্রম হল। ঠিক সময়মতো কাঁটালতা ভ্রাতঃ আমাকে উদ্ধার না করলে খাল বেয়ে পড়তাম ঠিক ঝরণার নিচে, ঠিক যেমনটি হলিউডি ছবিতে হয়। তবে ইন্ডিয়ানা জোন্সমশাই যেভাবে ওয়ানপিস শরীর নিয়ে ঝরণা থেকে উঠে আসেন তার বদলে আমাকে ভাঙা কাঁচের গেলাসের মতোই টুকরো টুকরো হয়ে পড়ে থাকতে হতো। চীৎকার করে বন্ধুদের ডাকলাম, কেউ সাড়া দিল না, দেওয়ার কথাও না অবশ্য।
যেসকল পাঠকদের সাথে আমার কিঞ্চিৎ পরিচয় আছে তাঁরা ইতোমধ্যে আকাশ থেকে না হলেও নিজ নিজ চেয়ার ছেড়ে ঠিকই পপাত ধরণীতল হয়েছেন। আমি তাঁদের দোষ খুব একটা দোষ দিচ্ছি না, তাঁরা নিশ্চয়ই ভাবছেন যেই ছেলেটাকে কম্পিউটারের সামনে থেকে হাতি দিয়ে টেনেও যদিবা ওঠানো গেল সে আবার ল্যাপটপ কোলে করে বিছানায় শয্যা নেয় সে এই গাড্ডায় এসে উপস্থিত হল কি প্রকারে? গুলতাপ্পি মারবারও তো একটা মিনিমাম ভদ্রতা আছে নাকি? আজকালকার ছোকরারা তিলকে তাল জ্ঞান করে …. আরে ধুত্তোর, রাখেনতো। আমাকে কিছু বলবার সুযোগ না দিয়েই একেবারে বিনা টিকিটে দিল্লি চলে যাচ্ছেন, একটু সুস্থির হয়ে বসেন, শুরু থেকে গোটা কাহিনীটা বর্ণনা করি তারপর নাহয় গালাগালি করে নিবেন মনের সুখে।
ব্যাপারটা শুরু হয়েছিল আমাদের ঘুরণচন্ডী গ্রুপখানার একজন সদস্যের খোমাখাতায় একটি লিংক শেয়ারের মাধ্যমে। সেখানে যাদিপাই নামের একটি ঝর্ণার ছবিসহ সেখানে যাত্রার কিছু ভয়ংকর বিবরণ দেওয়া। একদিনে পাহাড়ি পথে প্রায় বারো ঘন্টার হন্টন, দু’দুবার করে কিওক্রাডংয়ে আরোহণ, জোঁকের হোমগ্রাউন্ড, ঝর্ণায় নামবার কোন ট্র্যাক না থাকা - সবমিলিয়ে বেশ নির্মল একটা বর্ণনা। পুরোটা পড়েই গ্রুপের সবাই ঠিক করে ফেলল যে পুজোর ছুটিতে এই জায়গায় না গেলে চব্বিশ বছরের জীবন-যৌবন সবই বৃথা। আমাদের দলটা বেশ, ১১ জনের এ গ্রুপের দশজনেরই সাঁতারে দক্ষতা অনেকটা লোহার পেরেকের মতোই, বিন চশমায় চারজনের জগৎ অন্ধকার, একজনের নিত্যদিনের সঙ্গী হাঁপানি আর হাইপারটেনশন(লেখক স্বয়ং), আর প্রায় প্রত্যেকের ব্যক্তিগত সম্পত্তি হিসেবে আছে চমৎকার একটি নধরকান্তি ভুঁড়ি। আর বাকিরা যারা ও সম্পত্তি হতে বঞ্চিত তাদের ফিটনেস জয়নুলের দুর্ভিক্ষের ছবিগুলোর সাবজেক্টেদের মতো(যারা আমার বন্ধু অম্লানকে দেখেছেন তারা ভালো করে ব্যাপারটা বুঝতে পারবেন।)।
যাহোক, ট্যুর উপলক্ষ্যে ধুমধাম করে কেনাকাটা শুর হল, টয়লেট পেপার থেকে টর্চবাতি, কসকো থেকে কুইনাইন কিছুই বাদ গেল না। তারপর এক শুভরাত দেখে চেপে বসলাম বান্দরবানের বাসে, সকাল সকাল পৌছে গেলাম। এরপর চান্দের গাড়িতে রুমা, নৌকোয় রুমা বাজার সেখান থেকে গাইড ঠিক করে আবার চান্দের গাড়িতে উঠে বসলাম বগা লেকে যাওয়ার জন্য। জনাকুড়ি দশাসই বান্দাকে নিয়ে প্রায় পঞ্চাশ ডিগ্রী ঢাল বেয়ে বেয়ে কিভাবে যে জিপখানা ছুটছিল তা কল্পনার বাইরে যাত্রার শেষদিকে অবশ্য ভয় পাওয়ার আগ্রহটাও হারিয়ে ফেলেছিলাম। কয়েক ঘন্টা বা মাস পর কথাবার্তা ছাড়া হঠাৎ করে ড্রাইভার ঘ্যাচ করে ব্রেক কষল, নেমে জানতে পারলাম পাহাড় ধ্বসের কারণে আর গাড়ি যাবে না। অতএব গাট্টিবোঁচকাগুলো কাঁধে চড়িয়ে রওনা দিলাম সবাই। যাত্রার খুব বেশি বর্ণনা দেব না, তবে একবারে শেষ পথটুকু এতটাই সংকীর্ণ আর ঢালু ছিল যে প্রতি পাঁচমিনিট অন্তর অন্তর আমরা একে অপরের পিঠে ঠেস দিয়ে বিশ্রাম নিতে বাধ্য হয়েছি।
গাইড অনতিদূরে একটা সমতলে দাঁড়িয়ে আমাদের কান্ডকারখানা দেখে মুখে মুলোর দোকান খুলে খ্যা খ্যা করে হাসছে। ঐ হাসি দেখে আমাদের চটকানো পিন্ডি আরো চটকে গেল, পায়ের ব্যথা, পানির পিপাসা, শ্বাসের টান উপেক্ষা করে ধুপধাপ পা ফেলে গাইডের পাশে দাঁড়াতেই চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। কারণ শেষ পদক্ষেপটা দেবার সাথে সাথেই যেন মাটি ফুঁড়েই হঠাৎ বগা লেক তার সমস্ত সৌন্দর্য্য একসাথে জড়ো করে আমাদের মুখের উপর ছুঁড়ে মারল। সবাই বেশ খানিকটাসময় ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে রইল, সম্বিৎ ফিরে পেতেই ফটোগ্রাফাররা ঘ্যাচাঘ্যাচ স্ন্যাপ মারতে লাগল। ঐরাত বগালেকে আরাম করে খেলাম, ঘুমোলাম, সামনের আরো লম্বা জার্নিটার কথা মাথা থেকে সরিয়েই।
তবে পরদিনের জার্নির প্রথমভাগ, অর্থাৎ কেওক্রাডং আরোহণটা তেমন সমস্যা হয় নি। পথ বেজায় ঢালু, আর ঝোপেঝাড়ে কিছু জোঁক থাকলেও রাস্তা মোটামুটি প্রশস্তই ছিল। সোয়া তিনঘন্টার মাঝেই আমরা বঙ্গদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ শৃঙ্গটির টিকির নাগাল পেলাম। আমিই সবার প্রথম আরোহণের সম্মানটা নিতে পারতাম কিন্তু চূড়ায় ওঠার শেষ ধাপে ছিল আমার সবচেয়ে বড় শত্রুদের একটি - সিঁড়ি! কাজেই পেছন থেকে লম্বু জামিল ঢ্যাঙা ঢ্যাঙা কদম ফেলে প্রথম স্থান অধিকার করল, বুয়েটের মতো শ্বাপদ সংকুল জায়গায় সিজিপিএর দৌড়ে যাকে কেউ প্রথম স্থান থেকে বঞ্চিত করতে পারেনি সেই জামিলকে পরাস্ত করাটা আমার জন্য অনেকটা জিরাফ ডিঙিয়ে ঘাস খাওয়ার মতোই হয়ে যেত। যাহোক সবাই শীর্ষে পৌছে যাওয়ার পর আরেকটা মজার ব্যাপার আবিষ্কৃত হল যে কেওক্রাডংয়ে গ্রামীণের নেটওয়ার্ক আছে। সবাই পকেট ঝেড়ে মোবাইল বার করে খুটখাট করে বাসায় ফোন লাগাতে শুরু করল, এবং তাদের স্টার্টিং লাইন দিয়ে গ্রামীণের লোকজন বিনা কষ্টেই চমৎকার একটা বিজ্ঞাপন বানিয়ে ফেলতে
পারতেন,”মা আমি কেওক্রাডংয়ের চূড়া থেকে বলছি। হ্যা এখানেও নেটওয়ার্ক আছে!!”
যতো উঁচুই হোক না কেন, কেওক্রাডংকে আমরা বেশি সময় দিতে পারলাম না, কারণ সামনে আরো বন্ধুর পথ শত্রুর মতো অপেক্ষা করছে। ভালোমতন বিদায় না জানিয়েই হাঁটা ধরলাম যাদিপাইয়ের উদ্দেশ্যে। এবার অবশ্য কষ্ট অনেকটাই কম, কারণ পুরো পথটাই কেবল নিচে নামা। তবে শুনতে সোজা হলেও পথটা ছিল প্রায় পয়তাল্লিশ ডিগ্রী ঢালূ। সবাই দৌড়ে দৌড়ে নামছি আর এ পথদিয়ে আবার কিভাবে উঠবো সেই চিন্তা মাথা থেকে দূর করবার চেষ্টা করছি। যত বেশি সময় ধরে নামছি আত্মবিশ্বাসের পারদ নামছে তার দ্বিগুণ বেগে, কেজানে শেষমেষ হয়তো গরুছাগলের মতো গলায় দড়ি বেঁধে একেকটাকে টেনে উঠাতে হবে। দেড় কি দুই ঘন্টা এভাবে অধঃগামীতার পর অতি মনোরম এক দৃশ্য চোখে এল, সমতল!! আমরা বাক্সপ্যাটরা নামিয়ে একটু গড়িয়ে নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি অমনি বেরসিক গাইড তাড়া দিতে লাগল, যাদিপাই নাকি আর বেশি দূরে নয়। গজগজ করতে করতে অগত্যা সবকজনা আবারও উঠে দাঁড়ালাম। সমতলে হাঁটতে অবশ্য মন্দ লাগছিল না, একটা আদিবাসী পাড়া পেরিয়ে বেশ কিছুদূর আগানোর পর হঠাৎ গাইড সান্ত্রীর মতো সটান দাঁড়িয়ে পড়ল।
আমরা তখনও অতশত খেয়াল করিনাই, কারণ সকলেই তখন শরীরের অনির্ণেয়, অবর্ণনীয় গলিঘুঁজি থেকে জোক তাড়াতে ব্যস্ত। এই বনেবাদাড়ে রক্তদান কর্মসূচীতে অংশ নেওয়ার আশা বা আকাঙ্ক্ষা কোনটাই আমাদের ছিল না। মোটামুটি সারাশরীরে লবণের পলেস্তারা বসিয়ে গাইডের ঘাড়ের ওপর দিয়ে উঁকি দিতেই ঢক করে হৃদপিন্ডটা গলার কাছে ঠেকে গেল। এতক্ষণ যদি পঞ্চাশ ডিগ্রী নেমে থাকি তবে এটা পচাত্তর ডিগ্রীর কম হবে না। পেছনে স্বঘোষিত নাস্তিক প্রিননটাও মাকালী হতে শুরু করে আয়াতুল কুরসী পর্যন্ত জানা অজানা সব যন্তরমন্তর জপে যাচ্ছে। কি আর করা, ভাগ্যের হাতে নিজেদের সঁপে দিয়ে নামা শুরু করলাম। আগেই জানতাম যাদিপাই নামার কোন ট্র্যাক নাই, কিন্তু সেই "নাই"টার অর্থ কি এখন চাক্ষূষ করছি। কোনমতে লতাপাতা আঁকড়ে নেমে যাওয়া। এরমাঝে আমাদের গ্রুপের সবচেয়ে ফিট মেম্বার কজনা গাইডের সাথে সাথে বেশ এগিয়ে গেছে, আবার ওদিকে আমার পেছনের গুলো ভয়ের তাড়নায় এগোচ্ছে কচ্ছপের গতিতে। মাঝে আমি পড়লাম ফ্যাসাদে, সামনের গুলোকে ধরব নাকি পেছনের গুলোকে টানব? চিন্তাভাবনা করে স্বার্থপরের মতো সামনে এগোনোর সিদ্ধান্ত নিলাম(পরে এর ফল ভুগতে হয়েছে বলাই বাহুল্য)। সামনে এগোতে গিয়ে দেখি আরেক বিপদ, সামনের গুলো বেশি এগিয়ে গিয়েছে, অস্পষ্টভাবে ওদের বাতচিতের ধ্বনি কানে বাজছে কিন্তু সবাই চোখের আড়ালে। কি আর করার, আন্দাজে আন্দাজে এগোতে থাকলাম। পথের দিকে বেশি নজর দিতে গিয়ে খেয়ালই করিনি কখন অগ্রবর্তীতের কন্ঠ্যস্বর ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে আরব্য রজনীর জ্বীনের মতো বেমালুম হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়েছে। পথে একটা ডালপালার বিশাল প্রতিবন্ধক পড়ল, একটু অবাক হলাম। অন্তত এখানেতো ওদের কিছুক্ষণ অপেক্ষা করবার কথা। যাহোক অনেকটা বাহুবল খরচ করে ডালপালা সরিয়ে আবার এগোচ্ছি, কিন্তু সামনের পথ কঠিন থেকে কঠিনতর হচ্ছে। ধরে নামার মতো লতাপাতা বা পাথরদের টিকিটিরও দেখা পাওয়া যাচ্ছে না। আরো একটু এগোতেই মুখে যখন মাকড়শার জাল আটকানো শুরু করল তখন একরাশ ঠান্ডা জলের মতো উপলদ্ধির অনুভূতি আমাকে আঘাত করল - আমি ভূল পথে চলে এসেছি। এখন কি ফিরে যাবো? কিন্তু ঐযে সামনেই ঝর্ণার ঝংকার শোনা যাচ্ছে, নিশ্চয়ই অল্টারনেট রুট আছে ঝর্ণা পর্যন্ত যাওয়ার। বুদ্ধি বিবেচনার মুখে ছাই দিয়ে আবার সামনে এগোতে থাকলাম, হ্যা ঐতো ঝর্ণার আওয়াজ আরো জোরদার হচ্ছে ... কিন্তু একি, সামনে প্রায় কুড়ি ফুটের একটা উল্লম্ব ঢাল, এবং আপাত দৃষ্টিতে নামার কোন থিওরেটিকাল বা প্র্যাকটিকাল সলিউশানও দেখা যাচ্ছে না। আচ্ছা ঐযে একখানা পাথর তার লেজ বের করে আছে সেখানে শরীরের ভরটা দিলে কেমন হয়? চেষ্টা করতে গেলাম এবং অমনি পাথর বাবাজি কড়াৎ করে ভেঙে গিয়ে সানস্দে আমাকে সহ পড়লেন নিচের খালে ... তারপর? তারপরের মিনিটদশেকের কথা শুরুতেই বলেছি।
পানি থেকে ওঠার পর মিনিট দশেক ফুসফুসের সমস্ত শক্তি দিয়ে বন্ধুদের নাম ধরে ধরে চীৎকার করলাম। প্রথমে স্বাভাবিকভাবে পরবর্তীতে সভ্যতাবিবর্জিত বিশেষণযোগে। এর মাঝে হঠাৎ করে আকাশ কালো করে ঝমাঝম বৃষ্টি পড়তে শুরু করল, আরো চমৎকার। ফেরার বাকি আশাটাও গেল বলে। বেশ হতাশা চেপে বসল শরীরে, গাইড বলেছিল ঝর্ণার কাছেপিঠে একটা বাঁদরের গুহা আছে। শেষমেষ হয়তো ওখানে পৌঁছে বাকি জীবনটা বনের রাজা হিসেবেই কাটিয়ে দিতে হবে। কিন্তু হঠাৎ মনের কোণে ছোট্ট একটা কন্ঠ্য বলে উঠল, হাত পা সবই অক্ষত আছে তাও ফেরত যাওয়ার একটা চেষ্টা নিবি না মুখপোড়া? অ্যাঁ, তাইতো চেষ্টা করতে ক্ষতি কি। যে কুড়ি ফুট গড়িয়ে পড়েছিলাম তার কাছে গেলাম, এবার বেশ পরীক্ষা নিরীক্ষা করে, পাথর দিয়ে খুঁচিয়ে ফুটহোল্ড তৈরী করে আল্লা খোদার নাম করে পা রাখলাম এবং দুই টানেই উপরে পৌছে গেলাম, নিজের কৃতিত্বে তখন আমি নিজেই মুগ্ধ! উৎসাহী হয়ে আরো এগোতে শুরু করলাম। আমাদের ঘুরণচন্ডী দলটার একটি প্রায়লিখিত অবশ্যপালনীয় নিয়ম ছিল , যাত্রাপথে যতই কষ্ট হোক না কেন, মুখে কুলুপ এঁটে পুরো যাত্রা শেষ করতে হবে। ঢাকা শহরের নচ্ছাড় মশাকুলের মতো সহযাত্রীদের কানের কাছে প্যানপ্যান করা যাবে না। কিন্তু এখনতো আর কাছেপিঠে কেউ নেই কাজেই মনের আনন্দে কন্ঠ্যস্বরকে সপ্তমে চড়িয়ে সম্ভবপর সকল অব্যয়সূচক ধ্বনি উচ্চারণ আর সেই সাথে দূরদূরান্তের আত্মীয়স্বজনদের স্মরণ করতে করতে এগুচ্ছি। সকালের পর থেকে পেটে কিছু পড়েনি, কিছুক্ষণ আগে খেয়াল করেছি পানির বোতলটাও খোয়া গেছে এবং সেই সাথে আমার সাধের চশমাখানাও, হাঁপানির টানটাও বেশ জানান দিচ্ছে। ক্ষুধার্ত, তুষ্ণার্ত, প্রায়ান্ধ এই আমি আরো মিনিট কুড়ি হাঁচড়ে পাঁচড়ে উঠে একটা সমতল পেয়েই বসে পড়লাম। সামনে দশফুটি একটা ঢাল, নামার সময়ে বীরের মতো লাফ দিয়ে নেমেছিলাম। কিন্তু ওঠার ব্যাপারে শরীরের বাইরের এবং ভেতরের সকল অঙ্গ একসাথে রেড সিগন্যাল দিচ্ছে। মনের বেয়াদপ কন্ঠ্যস্বরটাও সুযোগ বুঝে হাওয়া হয়েছে। মাথা পুরোপুরি শূন্য, কোন অনুভূতিই কাজ করছে না। মিনিট পাঁচেক ঝিম ধরে বসে বসে বুষ্টিতে ভিজছি, এমন সময় খুব অস্পষ্ট একটা ডাক শোনা গেল। খুব একটা আমল দিলাম না, এমনিতেই মাথার ঠিক নাই ... কিন্তু ওকি, আবার শোনা গেল যে, আমার নিজের নামইতো মনে হচ্ছে! ঘ্যাস ঘ্যাস করে শরীরের শিথিল পেশীগুলোয় অ্যাড্রিনালিন পাম্প করা শুরু করল। উঠে দাঁড়িয়ে গলা ফাটিয়ে চীৎকার করলাম, জবাব পেলাম কিছুক্ষণ পর। আবার চীৎকার করলাম, জবাব পেলাম, আরো একটু কাছে থেকে। তৃতীয় কি চতুর্থবার চীৎকার করতে না করতেই দুজন বন্ধু সহ গাইডের মুখ দেখা গেল ঢালের উপর। গাউড শক্ত হাতে উপরে উঠালেন আমাকে। উপরে উঠে দেখি সবার তটস্থ অবস্থা, অম্লান, প্রিনন, হুমায়ুনের চোখে জল। রিফাত আর সামী ছুটে এসে যে জড়িয়ে ধরল আর ছাড়তেই চায় না। অবসন্ন শরীরের ওদের আলিঙ্গনে আবিষ্ট হয়ে মৃদু স্বরে বললাম, যাদিপাই দেখা হল না,শর্টকাটে মেধাবী হওয়াটাও মিস হল ... কিন্তু সত্যিই ... Life Is Beautiful!!!
এরপর ঐ তুমুল বৃষ্টির মাঝে ফিরে এলাম কিভাবে সে আরেক কাহিনী, পরে বলবখন কেমন?
পানিতে পড়বার সাথে সাথেই একটা গগনবিদারী চীৎকার দেওয়া আমার মতো সন্তরণবিদ্যায় অজ্ঞ বান্দাদের জন্য একটি ফরয কাজ। তবে এক্ষেত্রে ইচ্ছেটাকে বাস্তবে...
যাদিপাইয়ে যেভাবে মেধাবী হতে বসেছিলাম ...
About author: Fuad Naser
Cress arugula peanut tigernut wattle seed kombu parsnip. Lotus root mung bean arugula tigernut horseradish endive yarrow gourd. Radicchio cress avocado garlic quandong collard greens.
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
আমি যাবো :'(
উত্তরমুছুনলেখা তো সিরাম হইছে। বেস্ট অভ লাক...
উত্তরমুছুনতয় জানডা আছে এইটাই শুকরিয়া...
গুড পোস্ট। যাদিপাই ঝর্ণাটা কি জিনিস সেটা দেখতে গিয়ে অপরিচিতআবিরের ওয়েব আবিস্কার হলো।
উত্তরমুছুনযাদিপাইয়ে যেতে পারিনি - সময়ের অভাবে। প্রচন্ড ইচ্ছা ছিল যাওয়ার - দেখা যাক আবার কোন দিন যাওয়া যায় কিনা।
সাইট বানিয়েছেন, নিয়মিত লিখেন না কেন? ভালো থাকবেন