৯ ডিসেম্বর, ২০২০। সারা দিনের ঝক্কি ঝামেলা শেষে ল্যাপটপটার সামনে বসবার একটু সুযোগ মিলল। সরাসরি খোমাখাতায় প্রবেশ এবং সেখান থেকে একটি বিশেষ ইভে...

আবার হবে, হবে তো?



৯ ডিসেম্বর, ২০২০। সারা দিনের ঝক্কি ঝামেলা শেষে ল্যাপটপটার সামনে বসবার একটু সুযোগ মিলল। সরাসরি খোমাখাতায় প্রবেশ এবং সেখান থেকে একটি বিশেষ ইভেন্টের ওয়ালে। নাহ, আবারো হতাশ হতে হল, মাত্র চারজন অ্যাটেন্ডিং … হচ্ছে না, কিছুই হচ্ছে না।

উপরের কাজগুলো গত এক সপ্তাহ ধরে আমার দৈনন্দিন রুটিনের অংশ হয়ে গিয়েছে। প্রতিদিনই একই আশা এবং … হতাশা। নাঃ এবার তাহলে হচ্ছে না। জল অনেকদূর গড়িয়ে গিয়েছে, সবার হলুদ আবেগ হয়তো প্রশমিত হয়ে গিয়েছে এতদিন পর, ব্যস্ততার ধুসর কেড়ে নিয়েছে হলুদের জায়গাটা। ভালো লাগছে না, কিছুই কেন যেন ভালো লাগছে না …

কিভাবে আসবে সবাই? সবাই আজ নিজ নিজ জীবন নিয়ে ব্যস্ত। “ম্যান হু ড্রিংকস অ্যালোন” আপণদা নিশ্চয়ই নববর্ষে আবারো একাকী সূরার স্রোতে আকণ্ঠ্য নিমজ্জিত হওয়ার ফন্দী আঁটছে। লিমন ব্যস্ত পরকীয়ায়, এই নববর্ষের অজুহাতে বউকে ফেলে ঘুরতে যাবে অফিসের সেক্রেটারি নিয়ে। রাজু যাচ্ছে দ্বিতীয় মধুচন্দ্রিমায়, মালয়শিয়া। পিনুর বউ পিনুকে আসবার অনুমতি দেবে না, এবং অনুমতি জোগাড় করবার সাহসও বেচারার নেই। সাফার জন্য এখন চেয়ার ছেড়ে ওঠাটাই মুশকিল। জায়েদের বিদেশী এক কোম্পানীর সাথে জরুরী মিটিং … টকাটক চোস্ত ইংরেজির তোড়ে প্রতিপক্ষকে উড়িয়ে দেবার জন্য রাতদিন প্র্যাকটিস চালাচ্ছে। মিসির, মির্জা দেশে নেই বহুদিন, এ বছরই আসার কথা কিন্তু কোন খবর নেই। শরীফ আসিফ আজকাল পত্রপত্রিকায় কবিতা লিখে বেশ নাম কামিয়েছে, এখন সে টিভি চ্যানেলের টক শোগুলোর ভীষণ জনপ্রিয় মুখ, তারও নিশ্চয়ই সময় হবে না। পিয়াস, ফারজান্দরা তাদের স্মার্টনেসকে পুঁজি করে এবং সাকিব কঠোর পরিশ্রমের দ্বারা কর্পোরেট সিঁড়ি বেয়ে আজ অনেকদূরে উঠে গিয়েছে। আজ তাদেরও কোন খবর নেই। বন্ধন একটা বড় কোম্পানির ম্যানেজার, এবং তাকে ছাড়া সেখানে কোন কাজই হয় না বলাই বাহুল্য। গতকাল পত্রিকায় দেখলাম অ্যামেরিকান দুতাবাসের সামনে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গী সহযোগে মাতলামি করবার জন্য একজন কর্পোরেট কর্মকর্তা গ্রেপ্তার হয়েছেন, জাহিদুদুর এ মাসটা হাজতের পেছনেই কেটে যায় কিনা কে জানে। ভিসি বেচারা আবার বিয়ে করেছে, বেচারার কেন জানি বিয়ে টেকে না … অবশ্য সবার তো আর কল্লুর মতো ভাগ্য নয়। যাহোক কারোই সময় নেই। নেই আমার নিজেরও, সামনের সপ্তাহে অফিস থেকে একটা ট্যুরে যেতে হবে বাইরে, সময় নেই … একেবারেই সময় নেই।

সময় থাকলেই বা কি হতো? এত বছর পরও কি অম্লান আবার আসর মাতাতে পারবে? পারবে সারারাত স্বরচিত গান গেয়ে যেতে একটানা? টাল্টু, রাজিবভাই, মনিররা আবারো বং হাতে হাতে ধরিয়ে দেবে আমাদের? আবারও কি আহাদ হঠাৎ করেই তার লুকোন খাদ্যভাঁড়ারের প্রসাদ দিয়ে চমকে দেবে আমাদের? রিমন কি মিসিরকে দেখলে পালাবে আজো? মাইটি কি আবারও কন্টিনিউ করতে পারবে? তিহান, তানজিলদের মুখে আবারো কি তুবড়ি ছুটবে? জয়ের গীটারে আবারো সুর ফুটবে? কবির গান শুনে কি আবারো জন লেননকে তুচ্ছ মনে হবে? অর্পর দরাজ গলায় আবার কি হারাবো আমরা? আবারো কি গোটারাত খোলা আকাশের নিচে কাটাতে পারবো? রাস্তায় রাস্তায় উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়াতে পারবো? আবার অর্থহীন, বি-রেটেড গানের সাথে আমরা উদ্দামভাবে সব ভাবনা ঝেড়ে নাচতে পারবো?

চশমার কাঁচ ঝাপসা হয়ে আসে। চেয়ার ছেড়ে উঠে ওয়ারড্রোবের দিকে যাই, নিচের একটা ড্রয়ার খুললে একটা প্লাস্টিকের মোড়ক বের হয়। তার ভেতরে হলুদ একটা রংচটা টিশার্ট, একটা সস্তা হলুদ মাফলার, বাচ্চাদের একটা হলুদ সানগ্লাস আর সেলোফেনে মোড়া কিছু ছবি … সযত্নে রেখে দেওয়া। একটু হাত বোলাই জিনিসগুলোর ওপর, ছবিগুলো দেখি … মাঝে মাঝে হাসি, মাঝে মাঝে কাঁদি। আজ চোখের পানি ঠেকানোর জন্য মির্জা লাথি দিতেও আসে না, হুমায়ুন,রকি, অভিক, জিমিরা জড়িয়ে ধরে আশ্বস্ত করে না আজ - কেউ আজ কাছে নেই।

স্মৃতিগুলো হাতে করেই আবার ফিরে যাই ল্যাপটপের কাছে। পর্দায় চোখ পড়তেই হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে যেতে হয়, একি! ইভেন্টের ওয়াল পোস্ট আর কমেন্টের বন্যায় ভেসে যাচ্ছে! মার্গুব দাবী করেছে এবারের অনুষ্ঠান সে সবচেয়ে দামী রেস্টুরেন্টে আয়োজন করে ছাড়বে। শাফি মামা অনুষ্ঠানের জন্য বিদেশ থেকে টেনে নিয়ে আসছে মেটালিকাকে! জিয়া কেকের ডিজাইন আপলোড করেছে - দেখে সবার মাথা নষ্ট হয়ে যাবার জোগাড়। ইফতি, নাহিয়ান, মিঠু সব স্পন্সর ম্যানেজ করে ফেলেছে, সত্যি বলতে কি তারা নিজেরাই আজ স্পন্সর। নিলয় আবার কোথা থেকে একটা টিভি চ্যানেলও ম্যানেজ করে ফেলেছে। সৌমিকের পত্রিকা থেকে আসছে একঝাঁক তরুণ রিপোর্টার এই অসামান্য ইভেন্টের কভার দিতে। জ্যোতি, শোভন, অর্প আবারো নাচার ফন্দি আঁটছে। য্যাপ্পি দাবী করছে সে সবাইকে একটা সারপ্রাইজ দেবে, কি কে জানে। হুহু করে অ্যাটেন্ডিংয়ের সংখ্যা বাড়ছে - রিফাত কাকা, মাসুদ, পথিক, মোজো, সামি, আরিফ, রাফফান, পৃথ্বী, রাফি মামা, সাকি, কাকরা, অন্তর, আশিক, বিডি, সাস, এরশাদ, রূপম, জান, নয়ন, রাজন, রামিন, নিবিড়, কেষ্টা … কেউ বাদ নেই, এবং বরাবরকার মতোই ঐশটার কোন খবরই নেই। আমি চট করে ফোনটা তুলে ডায়াল করি, ওপাশে ফোন ধরতেই বলি - “স্যার সামনের ট্যুরটায় যাওয়া আমার সম্ভব হবে না, পার্সোনাল প্রবলেম … হ্যা, স্যার … জ্বী স্যার আমি জানি এটা একটা বিশাল অপরচুনিটি … জ্বী স্যার, এ চান্স আর নাও মিলতে পারে … স্যার, আমি সবই জানি তবুও যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। খুবই দুঃখিত স্যার। জ্বি স্যার, গুডনাইট।”

ফোনটা রেখে টিশার্টটার দিকে তাকালাম, কে জানে গত দশ বছরে সঞ্চিত ভুঁড়ির ভার সহ্য করতে পারবে কিনা। ইভেন্টের ওয়ালে আবার চোখ বোলাই, ৮৬ জন অ্যাটেন্ডিং। জমজমাট অবস্থা, সবাই কি হবে, কি করা যায় … এ নিয়ে তর্কাতর্কি করছে। প্রথমবারের আয়োজনে বুয়েট কেঁপে উঠেছিল, এবার কাঁপবে গোটা বাংলাদেশ। হাসিমুখে আমি “পাগলাগ্রুপের দশবছর পূর্তি ” ইভেন্টে অ্যাটেন্ডিং দিলাম।

হ্যা, আবারো ... আরো একবার খেলা হবে শুধু পাগলা-পাগলা!!

0 মন্তব্য(গুলি):