“আপনার দরকার ভাল ডাক্তার দেখানো।” আমি দ্বিতীয়বারের মতো ইমরুল ভাইকে বললাম “নতুবা ঘরে তালা মেরে রাখা ছাড়া আপনার কোন উপায় দেখছি না।” “আরে বাবা...

অরোরা দিয়ামেন্তে

“আপনার দরকার ভাল ডাক্তার দেখানো।” আমি দ্বিতীয়বারের মতো ইমরুল ভাইকে বললাম “নতুবা ঘরে তালা মেরে রাখা ছাড়া আপনার কোন উপায় দেখছি না।”
“আরে বাবা ডাক্তারতো দেখাচ্ছিই।” সিগারেটে দুটো মোক্ষম টান দিয়ে উদাস উদাস চেহারা করে ইমরুল ভাই জবাব দিলেন, “তবে ওষুধগুলো নিয়মিত খাওয়া হচ্ছে না এই আর কি... ওগুলোর যা দাম! তাও যদি একটা দু’টা কেইস-ফেইস জুটতো...”
ঠিক এই মুহূর্তটাতেই কাওসার আহমেদ চৌধুরীর ফোনটা এল। ইমরুল ভাই ফোনে বেশ খানিক্ষণ হুঁ-হাঁ করলেন, একবার ভয়ানক ধরনের ভ্রুকুটি করলেন, দু তিন বার মাথা চুলকালেন তারপর টপ করে সামনের দোকানের শেল্ফ থেকে একটা কলম টেনে নিয়ে খসখস করে কুড়িয়ে নেওয়া একটা ঠোঙায় কি যেন লিখতে লাগলেন হড়বড় করে। ফোন রাখার পর খুশী খুশী গলায় বললেন,”শনি বুঝি কেটেই গেল রে! শেষ পর্যন্ত একটা কেইস জুটেছে। মালদার পার্টি। চল যেতে যেতে বলছি।“ বলে হাঁটা ধরলেন।





আমি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম, তারপর কলমের দাম মিটিয়ে ইমরুল ভাইয়ের সাথে তাল মেলালাম।
“তো, কে এই মালদার পার্টি?” ভাইয়ের ডাক দেওয়া রিকশাখানায় আরাম করে উঠে বসে তারপর শুধালাম।
“কাওসার আহমেদ চৌধুরী। বিরাট বড়লোক। হরেক রকমের ধান্দা আছে তবে আসল টাকার উৎসটা কি কেউ ভাল করে বলতে পারে না।” ইমরুল ভাই এক মুখ ধোঁয়া ছেড়ে বললেন “তবে উনি একজন শখের সংগ্রাহক এবং-”
“-এবং ওনার শখের সংগ্রহশালা থেকে কেউ মাল সটকাচ্ছে এইতো??” আমি শেষ করে দিলাম, এ ধরনের কেইস আমার ভালই জানা আছে।

এভাবে পথ চলতে চলতে ভাই বিভিন্ন জায়গায় ফোন দিয়ে দিয়ে তার হবু ক্লায়েন্ট কাওসার আহমেদ চৌধুরীর ঠিকুজি-কুলুজি বংশলতিকা সব ঠোঁটস্থ করে নিলেন। অনেকটা পথ পরিক্রমা করবার পর রিকশা এক ধনী এলাকায় ঠেকল। বাকিটুকু পথ হেঁটে যেতে হবে কারণ এই এলাকায় রিকশা অচ্ছ্যুৎ। শেষমেশ যে জায়গায় পৌঁছালাম তা আধুনিক যুগের একটা রাজপ্রাসাদ বললে কম বলা হবে না। বিশাল দশফুটি প্রাচীরে ঘেরা সেই প্রাসাদে প্রবেশ করতে হল সিকিউরিটি ক্যামেরা, চার চারখানা আজদাহা গরিলাসদৃশ দারোয়ান এবং একজোড়া নেকড়েসদৃশ কুকুরের চেকপয়েন্ট পার হয়ে। ফিঙ্গারপ্রিন্ট স্ক্যানারখচিত আলিশান কাঠের দরজা পার হয়ে ঠাঁই হল ওয়েটিং রুমে নয়, বসার ঘরে। অবশ্য সেটাকে আর্ট গ্যালারি বললে খুব একটা ভুল হবে না। মনে, টিশিয়ান, পিকাসোর কিছু ছবির রিপ্রিন্ট, রিপ্রিন্টই এত সুন্দর কেজানে আসল ছবিগুলো দেখতে কেমন! সাজসজ্জা দেখে এতটাই অভিভূত ছিলাম যে খেয়ালই করা হয় নি কখন একজন ছোটখাট অতি সাধারণ চেহারার মানুষ এসে ইঁদুরের মতো সরু দুষ্টিতে আমাদের দেখছেন। ইমরুল ভাই প্রথম লক্ষ্য করে একটু হকচকিয়ে গেলেন, তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে পরিচয় দিলে ইঁদুরমানব ইঁদুরেরর মতোই মিহিকন্ঠ্যে বললেন,”আপনারা উপরে গিয়ে স্টাডি রুমে বসুন। স্যার আসছেন।”

অগত্যা কাঠের সিঁড়ি বেয়ে পৌঁছালাম, চোখ টোখ আবার কপালে তুলে ফেলতে হল। আমাদের স্কুল কলেজের লাইব্রেরীঘর গুলো বোধহয় এই স্টাডি রুম দেখলে লজ্জায় মুখ লুকিয়ে ফেলতো। লক্ষ্য করে দেখলাম বইগুলোর গায়ে তেমন একটা ধুলো জমেনি, হয় নিয়মিত সাফ করা হয় অথবা পাতা উল্টানো হয়... এসব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতেই রুমে প্রবেশ করলেন আমাদের ক্লায়েন্ট কাওসার আহমেদ চৌধুরী স্বয়ং। কেউ বলে দেয়নি তবুও একবারেই বুঝে গেলাম ইনিই এই বাড়ির মালিক। বেশ কয়েক পুরুষের জমিদারী নীল রক্ত পরিশিলীত এবং ঘনীভূত না হলে এমন চেহারা, ব্যক্তিত্ব বা হাঁটাচলা আয়ত্ব করা সম্ভব নয়। গলার স্বরেও পুরনো ধুলোমাখা গ্রামোফোন রেকর্ডের ছোঁয়া আছে যেন। কুশল বিনিময়ের পর্যায়ে জানা গেল ইমরুল ভাইয়ের শেষ জোড়াখুনের কেইসটার সমাধানপর্বের প্রত্যক্ষদর্শী এস.আই. কামরুল সাহেব যেচে পড়ে ভাইয়ের নাম তুলেছেন চৌধুরী সাহেবের কাছে।

“যাহোক যেকারণে আপনাদের এখানে ডাকা।” চৌধুরী সাহেব তাঁর জাঁদরেল গোঁফের ফাঁক দিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, “গত তিন মাসে আমার সংগ্রহশালা থেকে ছোট এবং মাঝারি গুরুত্বের তিনটি জিনিস খোয়া গিয়েছে। এই গতকালও... যাকগে সেগুলোর হদিশ আমি আপাতত চাই না। আমার ধারণা চোরটি বা চোরগুলো আসল জিনিসটা হাতানোর নিমিত্তে কেবল হাতমকশো করবার জন্যই ছোটখাট খুচরা জিনিসগুলো চুরি করেছে।”

“আসল জিনিসটা কি? আর ছোটখাট জিনিসগুলোই বা কিরকম?” ইমরুল ভাইয়ের গলার স্বর হঠাৎ পাল্টে গেল, আমি বুঝে নিলাম জেরা শুরু হচ্ছে।
“ওগুলো লাখখানেকের মতো দাম হবে, ছোটখাট জিনিস।” চৌধুরী সাহেব মাছি তাড়াবার ভঙ্গীতে যেন লাখখানেক টাকা হাত থেকে ঝেড়ে ফেললেন, “তবে ওদের নজর আমার অরোরা দিয়ামান্তের দিকে আমি ভাল করেই জানি।”
আমি মুখ চাওয়াচাওয়ি করবার জন্য ইমরুল ভাইয়ের দিকে তাকালাম, তবে ভাইয়ের দৃষ্টি সরাসরি চৌধুরী সাহেবের দিকে “আপনি কি অরোরার কলমটার কথা বলছেন?”
“শুধু কলম??” চৌধুরী সাহেব কলমের অপমানে আর্তনাদ করে উঠলেন, “বিশ্বের সবচেয়ে দামী কলম। দেড় মিলিয়ন সবুজ নোট লিখিত মূল্য, আর সংগ্রাহকদের কাছে এটা অমূল্য। ত্রিশ ক্যারেটের দুই সহস্র হীরকখন্ড দিয়ে তৈরী, ওটা কেবল একটা কলম নয়-“ বলে কিছুক্ষণ দম নিয়ে তিনি উত্তেজনা প্রশমন করলেন, “আমি ওটা বিক্রী করব না কিছুতেই কিন্তু কিছু দালাল চীনেজোঁকের মতো পিছে লেগে আছে গত কয়েক মাস ধরে। আমি নিশ্চিত ওরাই চুরিগুলো করাচ্ছে। এর মাঝে প্রাইভেট কালেক্টরদের দালাল হতে শুরু করে বড় বড় মিউজিয়ামের দালালরাও আছে। আমি মনে করি না এটা ওদের কারো শো-কেসেই শোভা পায়। ”
“রবি ঠাকুর বেঁচে থাকলে হয়তো তাঁর হাতে শোভা পেত হয়তো।” আমি ফুট কাটলাম পরিবেশ হাল্কা করতে, তবে খুব একটা সুবিধা হল না।
“যাহোক আমি একটা ছোটোখাটো ভল্ট এবং আরো কিছু সিকিউরিটির ব্যবস্থা করেছি। তবে ভল্টটা আসবে আগামীকাল সন্ধ্যায়। এই সময়টুকু আপনার উপস্থিতি দরকার, আর এর মাঝেই যদি চোর ধরতে পারেন তবেতো সোনায় সোহাগা।”
“বেশ কথা, তাহলে সিকিউরিটির দায়িত্ব পালন করবার জন্যই আমাকে তলব করা হয়েছে?” একটু শ্লেষমিশ্রিত গলায় ভাই প্রশ্ন করলেন।
“দেখুন গতর খাটানো লোকের অভাব নেই আমার আশেপাশে। মাথা খাটানোর লোক খুঁজে পাওয়াটাই যা মুশকিল। এই দেড়দিন নিরাপদে পার করতে পারলে আপনাকে খুশী করে দেব। আর যদি চোর পাকড়াও হয় তবে আপনি দ্বিগুণ খুশী হবেন।”
“সবই বুঝলাম। তবে যে জিনিসের জন্য এত তোড়জোড় সেটার দর্শন পেলে মন্দ হতো না।” ইমরুল ভাই যেন আমার মনের কথাটাই প্রতিধ্বনি করলেন।
“অবশ্যই অবশ্যই।” চৌধুরী সাহেব উঠে দাঁড়ালেন, “আপনাদের জন্যই আজ ওটা বের করিয়ে রেখেছি আমার সিন্দুক থেকে। এইতো এই টেবিলে-”

তিনি আর কথা শেষ করতে পারলেন না, তাঁর চোখ যেন কোটর ছেড়ে বেড়িয়ে আসছে, গলা চেপে ধরেছেন – নিশ্চয়ই শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে, ডান হাতের তর্জনী টেবিলের দিকে নির্দেশ করা তবে সেখানে কিছু নেই । আমি ঝট করে আগ বাড়িয়ে ওনাকে ধরে চেয়ারে বসালাম। তাঁর বুক হাঁপরের মতো ওঠানামা করছে।

“দৌড় দিয়ে নিচে যা।” ইমরুল ভাই ইস্পাতকঠিনস্বরে আদেশ দিলেন, কি ঘটেছে তা দু’জনই বুঝতে পারছি কাজেই আমাকে দু’বার বলতে হল না। এক ছুটে নিচে গিয়ে গার্ডদের বললাম গেট বন্ধ করে ভাল করে বাড়ির চারপাশ তল্লাশি করতে। তাদের নিরেট মাথায় ব্যাপারটার গুরুত্ব বোঝাতে বেশ সময় লাগল। সব বন্দোবস্ত করে ফিরে এসে দেখি চৌধুরী সাহেব বেশ সামলে নিয়েছেন, তাঁকে ঘিরে আছেন ইমরুল ভাই, সেই ইঁদুরমুখো ভদ্রলোক এবং একজন সুদর্শন যুবক। চৌধুরী সাহেবকে ধরাধরি করে বিছানায় পাঠিয়ে দেওয়া হল। এখন স্টাডি রুমে কেবল আমরা চারজন।


“দেখুন পুরো ব্যাপারটার একটা পুলিশি তদন্ত হবে। থানায় খবর চলে গিয়েছে।” পায়চারি করতে করতে ইমরুল ভাই গম্ভীরস্বরে বললেন, “তবে নীল পোষাক এসে হাজিরা দেবার আগে আমি আপনাদের কয়েকটি প্রশ্ন করতে চাই, আপনাদের কি আপত্তি আছে?” দুজনই কলের পুতুলের মতো মাথা নাড়লেন, বোঝা গেল দুজনই বেশ ভয় খেয়েছেন।

ভাই ইঁদুরমুখো ভদ্রলোকের দিকে দৃষ্টিপাত করতেই তিনি হড়বড় করে বলা শুরু করলেন, “দেখুন, আমি স্যারের সংগ্রহশালার দেখাশোনা করি, গত বছর পাঁচেক ধরে তা-ই করছি। আজ সকালে স্যার যখন বললেন কলমখানা বের করে রাখতে আমি তখন মুহিব সাহেবের থেকে চাবি নিয়ে সিন্দুক খুলে কেইসখানা স্যারের সামনে স্টাডিতে রেখে আসি, এর বেশি কিছু আমি জানি না।” এক দমে পুরোটা বলে তিনি লম্বা লম্বা শ্বাস নিতে লাগলেন যেন মাইলটাক দৌড়ে এসেছেন।
“খুব ভালো কথা, তবে নামটাই বলতে ভুলে গিয়েছেন।” ইমরুল ভাই মনে করিয়ে দিলেন।
“ও হ্যা, ইয়ে আমি উৎপল চন্দ্।” ইঁদুরমুখো আধহাত জিব কেটে জবাব দিলেন, “এম.এ পাশ করবার পর থেকেই স্যারের চাকরীতে ঢুকেছি। স্যার আমাদের গ্রামেরই লোক, গ্রাম সম্পর্কে-” ইমরুল ভাই হাত তুলে তাঁকে থামিয়ে দিলেন, “আপাতত জ্ঞাতিগুষ্টির পরিচয় না জানলেও চলবে। তো আপনি নিশ্চয়ই মুহিব সাহেব?” সুদর্শন ভদ্রলোক মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন, “আমি মুহিব চৌধুরী। আমি কাওসার কাকার ছোট ভাইয়ের ছেলে। কলেজ থেকেই কাকার বাসায় আছি। মাঝেমাঝে কাকার লেখালেখি, কাগজপত্র, হিসাব নিকাশে সাহায্য করি।”
“তো আপনার কাছেই চাবি থাকে সিন্দুকের?”
“না। কাকা সাধারণত মিনিটখানেকের বেশি ওগুলো নিজের হাতছাড়া করেন না। আজকে স্টাডিতে বসে যখন তিনি রোজকার মতো ব্রেকফাস্ট করছিলেন তখন আমাকে চাবিগোছা দিলেন উৎপলদাকে দেওয়ার জন্য। এরপর আমি কাকার জন্য পানি আনতে যাই কিছুক্ষণের জন্য। পানি নিয়ে এসে দেখি কাকা বাথরুমে গিয়েছেন। আর টেবিলে কলমের কেইসখানা এবং চাবির গোছা।”
“আপনার কাকা কতক্ষণ বাথরুমে ছিলেন?”
“মিনিটখানেক। উনি বেরিয়ে এলে আমি চাবি আর কলমের কেইস ওনাকে বুঝিয়ে দিয়ে আমার রুমে ফিরে যাই। সামনে আমার পরীক্ষা, পড়াশোনা করছিলাম। এমন সময় চীৎকার শুনে এখানে এসে দেখি এই অবস্থা।”
“তাহলে টেবিলের ওপর কতক্ষণ জিনিসখানা অরক্ষিত ছিল উৎপলবাবু?” ইমরুলভাই এবার ইঁদুরমুখোর দিকে প্রশ্নবাণ নিক্ষেপ করেন।
“বড়জোড় ত্রিশ সেকেন্ড।” উৎপলবাবু জবাব দিলেন ঘামতে ঘামতে “আমি সিঁড়ি দিয়ে নামবার সময়ই মুহিবসাহেব উঠছিলেন উপরে।”
ইমরুলভাই উঠে গিয়ে একবার স্টাডি রুমের জানালার কাছে গেলেন, আমিও গেলাম। বেশ উঁচু, কেউ ত্রিশ সেকেন্ডের মাঝে এই উচ্চতা যদি কাভার করতে পারে তবে সে নির্ঘাৎ স্পাইডারম্যান। আর তাছাড়া জানালা ভেতর থেকে বন্ধ, এবং বোমা মারলেও খুলবে কিনা সন্দেহ আছে।
এর মাঝেই দলবল নিয়ে পুলিশ হাজির হল। পুলিশ ইন্সপেক্টর আমাদের পরিচিত কামরুল সাহেব। তাঁকে অল্প কথায় গোটা পরিস্থিতি বুঝিয়ে দিয়ে আমাকে অবাক করে ইমরুল ভাই চৌধুরী সাহেবের প্রাসাদ ছেড়ে বেরিয়ে পড়লেন।

“ব্যাপার কি? আপনার জেরা শেষ হয়ে গেল?” ভাইয়ের কপালের ভাঁজের দিকে তাকিয়ে আমি ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম।
“হুঁ।” অন্যমনস্কভাবে ভাই জবাব দিলেন, “একটা রিকশা ডাকতো, এক জায়গায় যেতে হবে।”
“কোথায় যাচ্ছি?”
“ইমরান মোহাম্মদের কাছে।” রিকশায় উঠে তারপর ইমরুল ভাই জবাব দিলেন, “বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় জালিয়াত – যাকে বলে Forger”
ইমরান সাহেবের অফিস বেশ সাজানো গোছানো, কর্পোরেট কর্পোরেট গন্ধ। কেজানে হয়তো সকল কর্পোরেট অফিসই জালিয়াতি করে বলেই এই পরিচিত আবহাওয়া।
আমাকে এসির হাওয়া খেতে ওয়েটিং রুমে বসিয়ে ভাই ঢুকলেন ইমরান সাহেবের অফিসে, বের হলেন ঘন্টাখানেক পর। লক্ষ্য করলাম ভাইয়ের কপালের ভাঁজ গায়েব।
“ঐ বাড়িতে একটা ফোন লাগিয়ে বল আগামীকাল সন্ধ্যায় আমি চৌধুরী সাহেবের সাথে দেখা করতে চাই।” ভাই একটা সুন্দর বাক্স হতে একটা কার্ড বাড়িয়ে দিলেন।
“এটা আবার কোথায় পেলেন?” আমি নম্বর ডায়াল করতে করতে শুধালাম।
“টেবিলেই ছিল, ঝেড়ে দিয়েছি।” ভাইয়ের নির্বিকার জবাব।
এরপর বাইরে খানাদানা সেরে বেশ রাত করে আমরা ভাইয়ের বাসায় ফিরে গেলাম। ভাই এর মাঝেই বেশ কয়েকজায়গায় ফোন করে চোস্ত ইংরেজিতে খটরমটর করে কিসব কথাবার্তা বললেন যার বিন্দুবিসর্গও মাথায় ঢুকল না। তবে বুঝলাম ভাই বেশ সন্তুষ্ট।

ভাই বেশ আরাম করে গোটা রাত নাক ডাকিয়ে ঘুমোলেন, তবে আমার দুই চোখের পাতা এক হল না। ভাই কি আসলেই বিশ্বের সবচেয়ে অল্প সময়ে রহস্য সমাধানের রেকর্ড করতে পারবেন? ইত্যাদি ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়লাম কখন টেরও পেলাম না।

ঘুম ভাঙল বেলা করে, দেখি ভাই উধাও। ত্যক্ত হয়ে খাওয়া দাওয়া সেরে পত্রিকা উল্টাতে উল্টাতে দেখি ঘর্মাক্ত কলেবরে ভাই হাজির। এসেই তাড়া দেওয়া শুরু করলেন।
“চল চল, রামগড়ুড়ের ছানার মতো মুখ করে বসে আছিস কেন? লেট হচ্ছে তো! ”
গজগজ করতে করতে উঠলাম, চৌধুরী সাহেব গাড়ি পাঠিয়েছেন। বিনা ঝঞ্ঝাটেই পৌঁছে গেলাম তাঁর প্রাসাদে। ঢুকে দেখি পুরো মেলা বসে গেছে পুলিশের। গাদা খানেক পুলিশের মাঝে মুখ শুকনো করে মুহিব সাহেব এবং উৎপলবাবু বসে আছেন। আরেক পাশে বিশাল একখানা ভল্ট ফিট করা হচ্ছে দেয়ালে। সবাইকে নিচে রেখে আমরা দু’জন এবং ইন্সপেক্টর কামরুল উঠে গেলাম স্টাডিতে। সেখানে আমসির মতো মুখ কালো করে বসে আছেন চৌধুরী সাহেব।

“চৌধুরী সাহেব, আপনি কথা দিয়েছিলেন আপনার অরোরা’র নিরাপত্তা একদিন বজায় রাখতে পারলে আমাকে খুশী করে দেবেন আর চোর ধরলে দ্বিগুণ খুশী।” হালকা সুরে ভাই কথা গুলো বাতাসে ছড়ালেন, “খুশী করে দিন, একটা চেক লিখুন।”
“এ-এর মানে আপনি আমার অরোরার সন্ধান পেয়েছেন??” চৌধুরী সাহেবের চোখ প্রায় তাঁর বিলুপ্তপ্রায় পক্ককেশের আড়ালে হারিয়ে যাওয়ার পর্যায়ে।
“আপনি চেক লিখুন তারপর বাকি কথা।” শীতলস্বরে ভাই জবাব দিলেন।
বেশ খানিক্ষণ বোবার মতো তাকিয়ে থেকে তিনি ড্রয়ার থেকে একটা চেকবই বের করলেন। অ্যামাউন্ট আগে থেকেই লেখা ছিল কেবল সই করা বাকি, অ্যামাউন্ট দেখে আমার গলা শুকিয়ে গেল – যাঃ শালা! ভাইয়ের কাছে এবার একটা বাইক কেনার টাকা দাবী করাই যায়। চেকবই বের করে চৌধুরী সাহেব আবারো ড্রয়ার হাতড়াতে লাগলেন।
“কলম পাচ্ছেন না? এই নিন।” বলে ইমরুল ভাই বুক পকেট থেকে কি একটা বের করে এগিয়ে দিলেন এবং জিনিসটার দিকে চোখ পড়তেই আমাদের সকলের অজ্ঞাস হওয়ার দশা।
চুরুটের মতো মোটা শেইপের একটা ফাউন্টেইন পেন, জানালা দিয়ে আসা শেষ বিকেলের আলোতে চোখ ঝলসে দিচ্ছে সবার - অরোরা দিয়ামেন্তে!
“রহস্য খুঁজলে হতাশ হবেন।” ভাই একটু লজ্জিত ভঙ্গীতে বলা শুরু করলেন, “আমার একটা মানসিক সমস্যা আছে – ক্লেপটোম্যানিয়া। ছোটবেলা থেকেই এর ওর জিনিস ঝেড়ে দিয়ে অ্ভ্যস্ত, কখনো ধরা পড়তে হয় নি। গতকাল যখন সমস্যার কথা বলছিলেন তখনি আমার মনে হল জিনিসটার একদিনের সুরক্ষাই যখন প্রয়োজন তখন আমার হাতে থাকাটাই সবচেয়ে নিরাপদ। চোর ঘুণাক্ষরেও সন্দেহ করবে না। তাই একটু হাত সাফাই দেখিয়ে ঝেড়ে দিলাম।” অবলীলায় বলে চললেন ভাই, “আর গতদিন কয়েকটা সোর্স থেকে জানলাম আপনার সংগ্রহশালার সিপাহসালার উৎপলবাবু বেশ কিছু অ্যান্টিক আইটেমের মূল্য পরখ করতে একটি বিশেষ জায়গায় গিয়েছেন। আপনার টেবিলে গতকাল আপনার সংগ্রহশালার যে ক্যাটালগ পড়ে ছিল তা থেকেই জিনিসগুলোর পরিচয় জানতে পেরেছিলাম। আর কয়েকজন প্রাইভেট কালেক্টরের সাথে যোগাযোগের ব্যাপারটা সম্ভবত আপনার ভাতিজাই দেখেছেন, উৎপলবাবুকে দিয়ে টানা ইংরিজি বলানো সম্ভব বলে আমার মনে হয় নি। তো কামরুল সাহেব, বাকি দায়িত্ব আপনার, আমি আমার পাওনা বুঝে পেয়েছি। সবাইকে খোদা হাফেজ।”
বলেই হতভম্ব দুজনকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে আমাকে বগলদাবা করে ভাই বেরিয়ে এলেন প্রাসাদ থেকে।

রিকশায় ওঠার পরও অনেক্ষণ আমি কথা বলতে পারলাম না, তারপর কোনমতে বললাম, “এত দামী একটা জিনিস পকেটে নিয়ে ঘুরেছেন একদিন, আপনার কি ভয়ডর নেই??”
ভাই জবাব না দিয়ে একমুখ ধোঁয়া ছাড়লেন।
বাসায় পৌঁছে আবার ভাই ফোনে কার সাথে ইংরিজিতে বাতচিত করতে লাগলেন। আমার বিস্ময় তখনো কাটে নি। ফোনালাপের মাঝখানেই ভাই বললেন, “আজ রাতে এক খানদানি রেস্টুরেন্টে ডিনারের দাওয়াত, ঠিকানাটা বলছি লিখে নে।”
ভাইয়ের ছুঁড়ে দেওয়া কলমে ঠিকানাটা লিখতে লিখতে হঠাৎ মনে হল কলমটা বেজায় ভারী, ভাল করে তাকাতেই আমার হার্ট অ্যাটাক হওয়ার দশা...
আমার হাতে সেই জলজ্যান্ত অরোরা দিয়ামেন্তে!
আমি কোনমতে ভাইয়ের দিকে তাকালাম, তাঁর ফোনালাপ শেষ এখন আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছেন।
“কি আর করব, এই ডাচ হারামজাদারা চৌধুরী সাহেবের আগেই যোগাযোগ করেছিল, ডাবল মালকড়ির লোভ ঠেলতে পারলাম না। এখন বসে থাকিসনে। চট করে ইমরান সাহেবকে চৌধুরীর চেকখানা পৌঁছে দিয়ে আসতে হবে। অবশ্য ওর হাতের কাজের তুলনায় এটুকু পয়সা কিছুই না।”
“ও-ওরা যদি ওটা যাচাই করে দে-দেখে?” কোনমতে গলা দিয়ে শব্দগুলো বের করলাম আমি, গলা শুকিয়ে কাঠ।
“যাচাই করবে? করুক।” ভাইয়ের মুখের হাসি নেভেনি তখনো, “যাচাই করতে হলে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় জালিয়াতের কাছেইতো যেতে হবে নাকি?”
আমি মূঢ় হয়ে বসে রইলাম, মাথা পুরোপুরি ফাঁকা।
“চল চল দেরি করিস না। ম্যালা কাজ পড়ে আছে। ইমরান সাহেবকে চেক পৌঁছে আবার বাইকের শোরুমে একটা ঢুঁ মারতে হবে।” ভাই মুচকি হেসে বললেন, “এবার তোর জন্য একটা দামী বাইক না কিনলেই নয়!”



0 মন্তব্য(গুলি):