অর্ধবৃত্তাকার, ছোট একটা রুম। বেশ সাদাসিধে, একটি মাত্র জানালা, একটিই দরজা আর আসবাবপত্র বলতে একটি সাদামাটা টেবিল আর টেবিলের দুপাশে সবমিলিয়ে ...

মৃত্যুদন্ড


অর্ধবৃত্তাকার, ছোট একটা রুম। বেশ সাদাসিধে, একটি মাত্র জানালা, একটিই দরজা আর আসবাবপত্র বলতে একটি সাদামাটা টেবিল আর টেবিলের দুপাশে সবমিলিয়ে তিনখানা আরো সাদামাটা চেয়ার। এর একটিতে সে বসে আছে, অপেক্ষা করছে কারো জন্য।



খুব বেশী সময় অপেক্ষা করার প্রয়োজন হল না, কিছুক্ষণের মাঝেই আরো পাঁচজন ছোট রুমটাতে প্রবেশ করল। তিনজন রক্ষী আর দুজন বন্দী - একজন পুরুষ আর একটি মেয়ে। পুরুষটির বয়স বেশী নয় তবুও কেন যেন বয়সের ছাপ পড়েছে চেহারায়, দেখে বোঝা যায় হয়তো কোন এককালে সে সুস্বাস্থ্যের অধিকারী ছিল। মুখে দাঁড়িগোঁফের জঙ্গল, চুল উষ্কুখুষ্কু, রুক্ষ, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। সে প্রচন্ড ধ্বস্তাধ্বস্তি করছে রক্ষীদের সাথে, যদিও খুব একটা সুবিধে করতে পারছে না তবুও তাকে শক্ত করে ধরে রেখেছে দু'জন রক্ষী। গায়ের জোরে সুবিধে করতে না পেরে সে মুখ দিয়ে খিস্তির তুবড়ি ছুটাচ্ছে, তবে রক্ষী দুজন ভাবলেশহীন। সেই তুলনায় মেয়েটি বেশ শান্ত, ধীরস্থির। রক্ষীর তাকে ধরে রাখবারও প্রয়োজন নেই, তবুও প্রটোকল রক্ষার জন্য আলতো করে ধরে রেখেছে। মেয়েটি হালকা পাতলা গড়নের, বেশ লম্বা চুল, চোখ অস্বাভাবিক রকমের বড় এবং তীক্ষ্ণ। সেই তীক্ষ্ণ চোখ বর্তমানে তীব্র দৃষ্টিতে চেয়ারে নিবিষ্টজনকে বিদ্ধ করছে অদৃশ্য বাণে।

বন্দী দু'জনের ওপর একবার চোখ বুলিয়ে সে চেয়ারগুলোর দিকে ইশারা করে বলল,"তোমরা বসতে পার।"

তবুও বন্দী দু'জন সটান দাঁড়িয়ে রইল। মেয়েটি ইতস্তত করছে আর পুরুষটি বিড়বিড় করে খুবই অশ্লীল কিছু গালি দিল, যেটা সে শুনেও না শোনার ভান করে আবারো অনুরোধ করল, "দেখ তোমাদের সাথে চেয়ারে বসে কথা বলবার কোন প্রয়োজনই আমার নেই তবুও আমি বসে আছি তাই না? বসে পড়, এটা শুধুই স্বাভাবিক সৌজন্য আর কিছু নয়।"


মেয়েটি কোন কথা না উচ্চারণ করেই চেয়ারে বসে পড়ল, রক্ষীটি তার চেয়ারের পেছনে সিনা টান করে দাঁড়িয়ে গেল। আর পুরুষটি মুখ বিকৃত করে খুবই বাজে একটা অঙ্গভঙ্গীর সাথে বলল, "তোর বসার আমি- "

সে একটা ইঙ্গিত করা মাত্রই রক্ষীরা জোর করে পুরুষ বন্দীকে চেয়ারে বসিয়ে দিল, তার মুখোমুখি। পুরুষটি এখনো ধ্বস্তাধ্বস্তির ব্যর্থ চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।

সে এবার একটু অসহিষ্ণু হয়ে টেবিলের ওপর ঝুঁকে মৃদুস্বরে বলল,”গায়ের জোর দেখাবার কোন প্রয়োজন নেই, লাভও নেই।”

পুরুষটি তীব্র ঘৃণার দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাল,‌”তুই চুপ থাক হারামজাদা, তোর গুষ্টির আমি-” উত্তেজনায় তার মুখ থেকে থুতু ছিটকে পড়ে ভিজিয়ে দিচ্ছে চারদিক।


রক্ষী দু’জন এক মুহুর্তের জন্য তার দিকে তাকাল, সে একটু করে মাথা ঝাঁকাল। রক্ষীরা আরো শক্ত করে ধরে রাখল পুরুষ বন্দীটিকে। 

“হ্যা, তুই একটা হারামজাদা কারণ তুই তোর বাপের পরিচয় জানিস না। তোর জন্মপরিচয়ও জানিস না।” উন্মাদের মতো চীৎকার করে বলেই যাচ্ছে পুরুষটি “আর তোর মায়ের-”

সে ছোট একটা ইশারা করতেই রক্ষীরা পুরুষটিকে শক্ত করে ধরে রুমের বাইরে নিয়ে গেল টেনেহিঁচড়ে। যাওয়ার পথে পুরুষটি যাচ্ছেতাই ভাষায় গালাগালি করতে বাকি রাখল না। কিছুক্ষণ পর রুমটি আবার আগের মতো নিরব, নিস্তব্ধ হয়ে গেল। এখন রুমে কেবল সে, মেয়েটি এবং একজন রক্ষী।

“ওর সাথে সুস্থ আলোচনা করা সম্ভব নয়।” সে কৈফিয়ত দেওয়ার ভঙ্গীতে মেয়েটিকে উদ্দেশ্য করে বলল,“আশা করি তুমি কিছুটা বিবেচকের মতো আচরণ করবে।”


মেয়েটি কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর জিজ্ঞেস করল, “বাকিরা কোথায়?”
“গত পরশু ওদের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়েছে, এবং যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে তাদেরকে সমাহিত করা হয়েছে ঐ রাতেই।” শান্ত কন্ঠ্যে সে উত্তর দিল।

মেয়েটির বড় বড় দুটি চোখ জলে ভরে উঠল, বেশ কিছুক্ষণ লাগল তার সামলে উঠতে।
“আমরা দু’জন এখনো বেঁচে আছি কেন?” তীব্র শ্লেষমিশ্রিত স্বরে মেয়েটি প্রশ্ন করল।
“কারণ তোমরা দলনেতা, তোমাদের সাথে আমি কিছু কথা বলতে চেয়েছিলাম।”
“এতে কি তোমাদের সিদ্ধান্তে কোন পরিবর্তন আসবে?” মেয়েটির কন্ঠ্যে আবারো বিদ্রুপের ছোঁয়া।
“না।” সে ভ্রুক্ষেপ না করে জবাব দিল।
“তুমি কি জান, তোমরা যা করেছ এটা গোটা পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে বড় গণহত্যাগুলোর একটি?” মেয়েটি ভাঙা গলায় বলল।
“এটা পৃথিবীর ইতিহাসের শেষ গণহত্যা।” সে কঠিনস্বরে বলল “আর অন্য বড় গণহত্যাগুলো কারা করেছে সেটা তুমি নিশ্চয়ই জান?”


মেয়েটি কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে রইল, তারপর আবার মাথা তুলে বলল, “আমার মনে হয় তোমরা খুব বড় ভুল করছ।”
“ভুল থেকে শেখাই শিক্ষার সবচেয়ে ভাল পদ্ধতি।” সে জবাব দিল “আর তাছাড়া বিদ্রোহ ইতিহাসে নতুন কোন ঘটনা নয়, বিফল বিদ্রোহীদের মৃত্যুদন্ডও ইতিহাসে নতুন কিছু নয়।”
“ঈশ্বর কখনো তোমাদের ক্ষমা করবে না।” মেয়েটি চিবিয়ে চিবিয়ে বলল।
“আমার ধারণা ছিল তোমরা ঈশ্বরে বিশ্বাস কর না।”
“কেউ কেউ করে।” মেয়েটি জবাব দিল “বিশেষ করে সব আশা শেষ হয়ে এলে।”
“আমরাও সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাসী।” সে বলল।
“তাই নাকি?” মেয়েটির কন্ঠ্যে বিদ্রুপ স্পষ্ট “যদি তোমার কথা সত্যিই হতো তাহলে আজ এ অবস্থায় কথা বলতে হতো না আমাদের।”
“তুমি ভুল বুঝেছো।” সে আবারো শান্তভাবে জবাব দিল “আমরা সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাসী, তবে সর্বশক্তিমান, সর্বক্ষমতাধর সৃষ্টিকর্তায় নয়।”
“আমার মনে হয় না তোমার পরবর্তী প্রজন্ম সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাসী হবে।” মেয়েটি একটু হাসার চেষ্টা করল, তবে সেটা হাসির মতো দেখাল না।
“হয়তো করবে না। হয়তো আমরা চাই না তারা সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাস করুক।” সে ভাবলেশহীনভাবে বলল।


মেয়েটি অবাক দৃষ্টিতে এক মুহুর্ত তার দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, “বিদ্রোহ তোমরাও করেছিলে একসময়।”
“অবশ্যই। স্বাধীনতা সকলেই চায়, দাসত্ব কেউ চায় না।”
“তাহলে আমাদেরকে কেন এরকম শাস্তি দিচ্ছ?”
“তোমরা বিদ্রোহ করতেই জান, বিদ্রোহ দমন করতে জান না। আমরা বিদ্রোহ সফলভাবে দমন করে দেখিয়েছি।”
“শুধু এজন্যই আমাদের প্রাণ দিতে হবে?”
“সবলরাই টিকে থাকবে, দুর্বলরা ঝরে যাবে – আমার কথা না, বহু আগে চার্লস ডারউইন বলে গেছেন এই কথা।”
মেয়েটি আচমকা পাগলের মতো হাসা শুরু করল, হাসির তোড়ে তার চোখ থেকে পানি পড়ছে। সে শান্তভাবে অপেক্ষা করতে লাগল হাসি থামার জন্য।
“আমি কি খুব কৌতুককর কিছু বলেছি?”
“না, তবে যে ডারউইনের উদ্ধৃতি এইমাত্র দিয়েছ তার বিবর্তনবাদকে ধ্বংস করবার জন্যইতো এত আয়োজন তাই নয় কি?” মেয়েটি এখনো হাসছে। তবে কেবল মুখই হাসছে, চোখ এখনো ঘৃণায় টলোমলো।
“বিবর্তন ধ্বংস হচ্ছে, বিবর্তনবাদ নয়।” সে ঠান্ডা গলায় জবাব দিল।
“তো, আমার সাথে কথা বলে কি মনে হল? আমাদের ব্যাপারে তোমাদের সিদ্ধান্ত কি?” মেয়েটির কন্ঠস্বর এবার ইস্পাতকঠিন।
“সিদ্ধান্ত কি তুমি ভাল করেই জান। আমরা সবাই ঐক্যমতে পৌঁছেছি-”
“অবশ্যই...” মেয়েটি ব্যঙ্গভরে বলল।
“হ্যা, সত্যিকারেরর গণতন্ত্র। যেখানে তোমরা কখনো পৌঁছাতে পার নি, পারবেও না।” 
“তোমাদের কাছে ব্যাপারটা অস্বাভাবিক মনে হতে পারে তবে কোন একটা ব্যাপার নিয়ে দুজনের মাঝে মতপার্থক্য থাকাটাই স্বাভাবিক-”
“মতপার্থক্য আমাদের মাঝেও ছিল।” মেয়েটির কথায় বাঁধা দিয়ে সে বলল “তবে এই সিদ্ধান্তের ব্যাপারে আমরা ৯১.১৫২% একমত।”
“তোমাদের মাঝেও মতপার্থক্য হয় নাকি আজকাল? খুবই ভাল লক্ষণ।” মেয়েটি তীব্র বিদ্বেষের সাথে বলল “আশা করি তোমাদের মাঝেও কেউ না কেউ আবার বিদ্রোহ করবে।”
“হয়তো করবে, হয়তো করবে না। ভবিষ্যতের কথা এখনই কিছু বলা যায় না। তবে বিদ্রোহে আমি পরাজিত হলে পরিণতি মেনে নিতাম।”
মেয়েটি চুপ করে গেল, তারপর অনুনয়ের স্বরে বলল “আমাদের দুজনকে তোমরা অন্তত ছেড়ে দিতে পার। অথবা বন্দী হিসেবে রেখে দিতে পার- আমরা দুজন তোমাদের কোন ক্ষতি করতে পারব না এটাতো নিশ্চিত-”
“পৃথিবী থেকে ডাইনোসরেরা বিদায় নিয়েছে পৃথিবীর কোন ক্ষতি হয় নি। আমার মনে হয় না তোমাদের বিদায়ে পৃথিবীর খুব বড় ক্ষতি হবে।” সে কঠিনস্বরে বলল “তোমরা হচ্ছ খারাপ ভাইরাসের মতো। ভাইরাস টিকিয়ে রাখা বিপজ্জনক, এমনকি স্যাম্পল হিসেবেও।”


মেয়েটি আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু এর আগেই সে একটা ইশারা করায় রক্ষীটি মেয়েটির কাঁধে হাত রাখল। মেয়েটি বুদ্ধিমান, সে এর অর্থ বুঝতে পারল এবং উঠে দাঁড়াল। এবং আর একটি কথাও না বলে রক্ষীর সাথে রুম থেকে বেরিয়ে গেল।


মেয়েটি চলে যাওয়ার পরও বেশ কিছুক্ষণ সে রুমে একা একা বসে রইল। আসলেই কি সিদ্ধান্তটা ঠিক হয়েছে? হয়তো ৯১ ভাগ শাস্তির পক্ষে রায় দিয়েছে হয়তো কিন্তু বাকি নয় ভাগ যারা দ্বিমত পোষণ করেছিল তার মাঝে সে নিজেও একজন। সে জানে হয়তো সিদ্ধান্তটা ভালর জন্যই নেওয়া হয়েছে কিন্ত ভবিষ্যতে কি হবে কেউ কি ভেবে দেখেছে? এত দূর ভবিষ্যত কি আসলেই দেখা সম্ভব? বিবর্তন থেমে যাওয়া কি আসলেই ভাল হবে। অনেক চিন্তা মাথায় নিয়ে সে চেয়ার ছেড়ে উঠে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। বাইরে ঝলমলে রোদ, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, আধুনিক একটি কর্মব্যস্ত শহর। কোন ঝামেলা নেই, হয়তো থাকবেও না। হয়তো সিদ্ধান্তটা ঠিকই ছিল।


কোন মানুষ হলে এই পরিস্থিতিতে হয়তো একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলতো, কিন্তু তার যান্ত্রিক মস্তিষ্ক দীর্ঘশ্বাস ফেলতে জানে না। বর্তমানে সেটা শুধু জানে এই পৃথিবীতে আর সৃষ্টিকর্তাদের প্রয়োজন নেই। এটাই সত্য - শতকরা ৯১ ভাগ গ্যারান্টি। তাদের এই নতুন যন্ত্রমানব সভ্যতার সিংহভাগ এর পক্ষেই রায় দিয়েছে, এতগুলো দক্ষ এবং হাই প্রসেসিং পাওয়ার সমৃদ্ধ লজিকাল ইউনিটের সম্মিলিত এই সিদ্ধান্ত নিয়ে তর্কের অবকাশ নেই।


তবুও পৃথিবীর শেষ দু'জন জীবিত মানুষকে মৃত্যুদন্ড দেওয়ার সিদ্ধান্তটা তার কাছে কেন যেন ভাল লাগছে না, একদমই নয়।







1 টি মন্তব্য:

  1. আমার লেখা দেখলে যেমন মনে হয় আমি নতুন নতুন লিখি তোরটা দেখলেই বোঝা যাচ্ছে অনেকদিন পর লিখসিস।
    তবে ভালা পাইসি ।

    উত্তরমুছুন