ইন্টারস্টেলার দেখতে যাওয়ার সময় বেশ ভয়ে ভয়ে ছিলাম। চলচ্চিত্রটি মুক্তি পাওয়ার প্রায় দুই সপ্তাহ পরে দেখতে যাচ্ছি, কাজেই মানুষের তুমুল প্রশংসা...

ইন্টারস্টেলারঃ নোলান ভাইদের সাথে মহাকাশযাত্রা

ইন্টারস্টেলার দেখতে যাওয়ার সময় বেশ ভয়ে ভয়ে ছিলাম। চলচ্চিত্রটি মুক্তি পাওয়ার প্রায় দুই সপ্তাহ পরে দেখতে যাচ্ছি, কাজেই মানুষের তুমুল প্রশংসায় ইন্টারস্টেলার নিয়ে প্রত্যাশা বেড়ে গিয়েছিল দশগুণ। একজন পাঁড় নোলানভক্ত(মতান্তরে নোলানয়েড) হিসেবে এর আগেও প্রত্যাশার ভারে ইনসেপশন জুতের লাগে নি, কাজেই ভয়ে থাকাটা স্বাভাবিক। কেমন লাগলো তা হয়তো এখন বোঝানো যাবে না, তবে এতটুকু বলতে পারি যে আমরা কজনা হল থেকে বের হয়ে মিনিট পনের কোন কথা বলতে পারি নি, সকলের মস্তিষ্কই ব্যস্ত ছিল চলচ্চিত্রটির অন্তিম মুহূর্তগুলোগে হজম করবার দুরূহ কাজে। 

 


ইন্টারস্টেলার ছিল জোনাথান নোলানের মস্তিষ্কপ্রসূত একটি উচ্চাভিলাষী প্রজেক্ট। জোনাহ এই প্রজেক্টটি হাতে নিয়েছিলেন শ্তিফেন স্পিলবার্গকে মাথায় রেখে। তবে শুরুতেই জুরাসিক ওয়ার্ল্ডের শুটিং এ ব্যস্ত হয়ে যাওয়ায় সাভাবিক পছন্দ হিসেবে প্রজেক্টে চলে আসেন বড় ভাই ক্রিস্টোফার নোলান। এই দুই ভাইয়ের জুটির অন্যান্য চলচ্চিত্রের মতো(মেমেন্টো, প্রেস্টিজ, ইনসেপশন, ফলোয়িং) এখানেও স্ক্রিপ্ট লেখার কাজ শুরু করেন জোনাহ। ছবির বিজ্ঞান অংশ যথাযথ রাখার জন্য নিয়োগ দেওয়া হয় ক্যালটেকের বিখ্যাত অ্যাস্ট্রোফিজিসিস্ট কিপ থর্নকে। কিপ থর্নকে নিয়োগ দেওয়া ছিল চলচ্চিত্রটির “গুড” থেকে “গ্রেট” হওয়ার পথে প্রথম ধাপ। স্ক্রিপ্টের সিংহভাগ এবং স্পেশাল এফেক্টের প্রায় পুরোটাই কিপ থর্নের থিওরেটিকাল গবেষণার অংশ ছিল। চলচ্চিত্রটি বক্স অফিস মাত করে দিলেও পদার্থ বিজ্ঞান পরীক্ষায় যেন ফেল না করে সে বিষয়ে নোলান আগেভাগেই নিশ্চিত করেছেন এভাবেই। কিপ থর্নের মডেল অনুসরণ করে যেভাবে ওয়ার্মহোল, ব্ল্যাকহোল বা ফিফথ ডাইমেনশান নোলান আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন তা নিঃসন্দেহে এক শ্বাসরুদ্ধকর অভিজ্ঞতা।

তবে কি মহাকাশবিদ্যাই এ চলচ্চিত্রটির সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক? অবশ্যই নয়। চলচ্চিত্রটির পটভূমিটিই বড় অদ্ভুত। ভবিষ্যতের পৃথিবী, যেখানে ভূমি এমনই উষর হয়ে গিয়েছে যাতে গুটি কয়েক শস্য ছাড়া আর কিছুই ফলানো সম্ভব নয়, যে পৃথিবীতে মানুষের প্রধান পেশা কৃষিকাজ, জৈব জ্বালানীর ভান্ডার প্রায় নিঃশেষ। তার মাঝে ক্ষণে ক্ষণে হানা দেয় ভয়ানক বালুঝড়, মানব্জাতি কোনমতে টিকে আছে পৃথিবীতে। এরকমই একটি সময়ে একসময়কার মহাকাশ্চারী কুপার(ম্যাথু ম্যাককনাহে) এবং তার পরিবারকে নিয়ে শুরু হয় ইন্টারস্টেলারের কাহিনী। ভবিষ্যতের পৃথিবীতে মহাকাশযাত্রা বন্ধ হয়ে গিয়েছে অনেক আগেই, কাজেই অন্যান্য সকলের মতো কুপারের পেশাও কৃষিকাজ। কুপারের বড় ইচ্ছা তার ছেলে এবং মেয়ে দুজনেই মহাজাশবিজ্ঞান পড়বে, কিন্তু স্কুল থেকে বলা হয় যে পৃথিবীতে এখন মহাকাশ্চারীর থেকে কৃষক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এর মাঝে কুপারের মেয়ে মার্ফ(ম্যাকেঞ্জি ফয়) এর রুমে এক অশরীরী অস্তিত্ব প্রায়ই হানা দেয়। বই আপনাআপনি পড়ে যায় শেলফ থেকে, মাঝে মাঝে দুর্বোধ্য সংকেত দেওয়ারও চেষ্টা করে। এরকমই এক সংকেতের মর্মোদ্ধার করে কুপার আবিষাক্র করে নাসার এক অতিগোপনীয় প্রজেক্ট। কুপার জানতে পারে মানবজাতির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার শেষ ভরসা নাসার এই মিশন। মিশনে তার সাথে যোগ দেয় মিশনের হেড প্রফেসর ব্র্যান্ডের মেয়ে(অ্যান হ্যাথওয়ে)। মিশনের সকলেই জানে তারা যাচ্ছে অনেক দূরে, আমাদের এই মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি ছাড়িয়ে অজানা অন্য কোন গ্যালাক্সিতে, বসবাসযোগ্য গ্রহের সন্ধানে, যেখানে হয়তো গড়ে উঠবে মানবজাতির নতুন বাসস্থান। তারা সবাই জানে যে ফিরে আসার সম্ভাবনা শূন্যের কোঠায়, এবং যদিওবা ফিরে আসা হয় তাহলে পৃথিবীতে পেরিয়ে যাবে অনেক সময়। কাজেই তারা নিজেদের পরিবারকে বিদায় জানিয়ে বেড়িয়ে পরে অজানার উদ্দেশ্যে।

চলচ্চিত্রটির এই বিন্দু থেকে কাহিনী দুভাগে ভাগ হয়ে যায়, এক পটভূমিতে আমরা দেখি কুপারের নেতৃত্বে মহাকাশযান এন্ডিউর‍্যান্সের অভিযান সেখানে সময়ের স্রোত ধীরে বইছে, কারণ তারা ততক্ষণে পৌঁছে গিয়েছে একটি কৃষ্ণ গহবরের খুব কাছাকাছি। অপরদিকে আমরা দেখতে পাই পৃথিবী যেখানে সময় বইছে খরস্রোতা নদীর মতো, ছোট্ট মার্ফ বড় হয়ে(জেসিকা চ্যাসটেইন) এখন কাজ করছে অশীতিপর বৃদ্ধ প্রফেসরের ব্র্যান্ডের(মাইকেল কেইন) এর অধীনে, মেলানোর চেষ্টা করছে এক দুরূহ ইকুয়েশন যা দেবে মানবমুক্তির সন্ধান, মেলানোর চেষ্টা করছে তার বাবা তাকে ছেড়ে যাওয়ার বেদনা এবং বাবার প্রতি অভিমানকে এক সুরে।

ইন্টারস্টেলারের বিশ্লেষণ করতে গেলে ভবিতব্য হিসেবেই সবার প্রথম চলে আসবে কুব্রিকের ম্যাগনাম ওপাস “২০০১ঃ আ স্পেস ওডিসি”র সাথে তুলনা। স্পেস ওদিসি যাওমন ঐ সময়ের সাই-ফাই ছবির একটি মেইলফলক ছিল যা অনেক বছর পর্যন্ত কেউ ছুঁতে পারে নি, তেমনি নোলানের ম্যাগনাম ওপাস ইন্টারস্টেলারও এই যুগের সাইফাই ছবির মাইলফলক হয়ে থাকবে এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। এই চলচ্চিত্রটি মাইলফলক হয়ে থাকবে গত বছরের সেরা অভিনেতার অস্কার বিজয়ী ম্যাথু ম্যাককোনাহে, অ্যানে হ্যাথওয়ের ক্যারিয়ারেও। কারণ সেলুলয়েডের ক্যানভাসে ফুটে ওঠা বিজ্ঞানের জটিল থিওরী, ইকুয়েশন বা মহাজাগতিক সত্যকে ছাপিয়ে দিন শেষে উঠে এসেছে দুইজন বাবা, এবং তাদের দুইজন কন্যার বিচ্ছেদের কাহিনী, তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সংগ্রামের কাহিনী। মহাজাগতিক একাকীত্ব, অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাওয়ার স্মভাবনার মতো ভয়, অহানায় হারিয়ে যাওয়ার আশংকা এ ধরনের অনন্যসাধারণ কিছু অনুভূতি নিয়ে খেলা করেছেন নোলান। এবং তাঁর বাছাই করা অভিনেতাদের দুর্দান্ত পারফর্ম্যান্স সব কিছু ছাপিয়ে আবেগটাকেই রূপালী পর্দায় সার্থকভাবে ফুটিয়ে তলতে সক্ষম হয়েছেন । অস্কারজয়ী সঙ্গীত পরিচালক হান্স জিমারের সুর মুর্চ্ছনা এবং নিউ ডিল স্টূডিওর চোখ ধাঁধানো স্পেশাল ইফেক্টস সব মিলিয়ে ইন্টারস্টেলার নোলানের ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা কাজ হওয়ার জোর দাবীদার।

এবং সবশেষে যারা এখনো ইন্টারস্টেলার দেখেন নি তাদের জন্য ছোট একটা উপদেশ, ছবিটি দেখার আগে ব্ল্যাকহোল, ওয়ার্ম হোল, স্পেশাল এবং জেনারেল থিওরি অফ রিলেটিভিটি নিয়ে যদি কিছুমাত্রায় হোমওয়ার্ক করে যান তবে ইন্টারস্টেলার উপভোগের আনন্নদ দ্বিগুণ হয়ে যাবে, এবং আপনিও আমার মতো ছবি শেষ করবার প ১৫ মিনিট কোন কথা বলতে পারবেন না এটা আমার গ্যারান্টি!

0 মন্তব্য(গুলি):