... রক্তমাখা মুখে ভয়ংকরভাবে ছেলেটা হেসে উঠল, আনন্দের হাসি নয়, বুকের রক্ত জমানো অট্টফাসি। সেই সাথে অন্যরাও অপ্রকৃতিস্থদের মতো সমস্বরে হাসতে ল...

দুঃস্বপ্ন

... রক্তমাখা মুখে ভয়ংকরভাবে ছেলেটা হেসে উঠল, আনন্দের হাসি নয়, বুকের রক্ত জমানো অট্টফাসি। সেই সাথে অন্যরাও অপ্রকৃতিস্থদের মতো সমস্বরে হাসতে লাগল হা হা করে ... আবেদ সাহেবের মেরুদন্ড দিয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেল ... এর মাঝে তিনি শুনতে পেলেন তারা সবাই বলছে, "মর, মর, তুই মর আবেদ ... তোর ধ্বংস হোক ... তোর ফাঁসি হোক ..."

আবেদ সাহেব ধড়ফড় করে বিছানায় উঠে বসলেন। তাঁর সারা শরীর ঘামে ভিজে গেছে। টেবিলে রাখা পিরিচে ঢাকা এক গ্লাস পানি এক নিশ্বাসে ঢকঢক করে খেয়ে ফেললেন। আবারো সেই একই দুঃস্বপ্ন। এতোবার এই একই দুঃস্বপ্ন দেখার পর যদিও এটা অভ্যাস হয়ে যাওয়ার কথা তবুও কেন জানি প্রতিবারই এই দুঃস্বপ্নটা দেখবার সময় আবেদ সাহেবের জান গলার কাছে চলে আসে। তিনি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলেন, সকাল পাঁচটা বাজে। তড়িঘড়ি করে তিনি বিছানা ছেড়ে উঠলেন। আজ একটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ দিন। অনেক কাজ, অনেক ব্যস্ততা। ১৬ ডিসেম্বর, বিজয় দিবস বলে কথা। তাঁর মতো একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং মন্ত্রীর যে শ্বাস ফেলবার অবকাশ থাকে না তা বলাই বাহুল্য।

ডাইনিং রুমে আসতেই তাঁর ছেলে স্বাধীন তাকে জড়িয়ে ধরল।

"বাবা, একাত্তরের দিনগুলি বইটা পড়ছি, ফাটাফাটি বই।" সে বলল।

"ফাটাফাটি তো হবেই।" আবেদ সাহেব স্মিত হেসে ছেলের মাথায় হাত রেখে বললেন, " একইসাথে মুক্তিযুদ্ধের এরকম সুন্দর এবং ভয়ংকর বর্ণনা খুব কমই আছে। তুমি আরো বই পড় আরো জানতে পারবে। এখন বাবার কাজ আছে ব্যাটা... আমাকে যেতে হবে। রাতে আমরা বইটা নিয়ে আলাপ করবো কেমন?"

স্বাধীন তাঁকে ছেড়ে দিল, একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হওয়ায় সে যে কতটা গর্বিত তা যদি একবার তার বাবা জানতো!

তাঁর স্ত্রী তাঁকে দরজা থেকে বিদায় জানালেন, যুদ্ধের পরে বিয়ে হলেও মুক্তিযোদ্ধা স্বামী নিয়ে তিনিও গর্বিত।

আবেদ সাহেব অনেকগুলো অনুষ্ঠানে হাজিরা দিলেন। বিশেষ করে দুঃস্থ মুক্তিযোদ্ধাদের একটা অনুষ্ঠানে তাঁর মর্মস্পর্শী বক্তব্যে সবার চোখে পানি চলে এল। আজকালকার তরুণ যুবারা তাঁর মতো প্রাগৈতিহাসিক ডাইনোসরদের সাধারণত পাত্তা দিতে চায় না কিন্তু তরুণদের এক সমাবেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চেয়ে এমন ভয়ংকর বক্তৃতা দিলেন যে উপস্থিত তরুণদের রক্ত গরম হয়ে উঠল। পরে তাঁর সেক্রেটারী দিলারা তাকে এক ফাঁকে জানিয়ে গেলেন যে গোটা ফেসবুক নাকি তাঁর প্রশংসায় সয়লাব হয়ে যাচ্ছে। সকালে মনে জড়ো হওয়া গুমোট ভাবটা কেটে গেল আবেদ সাহেবের, সেখানে ফুটল তৃপ্তির হাসি।

দিনের শেষে টেলিভিশনে একটি সাক্ষাৎকার। সারাটাদিন ভালভাবেই গেছে, শেষ এই ঝামেলাটা ভালয় ভালয় কাটলে হয়, তিনি ক্লান্ত মনে ভাবলেন।

সাক্ষাৎকারটা ভালভাবেই কাটল। তিনি প্রত্যন্ত অঞ্চলে কিভাবে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন তার বর্ণনা দিলেন, আর তার শেষ অপারেশনটা, যেটায় তাঁর সহযোদ্ধারা সবাই মারা গিয়েছিল তার কথা বললেন। সবশেষে উপস্থাপক জিজ্ঞেস করলেন, “আমরা জানতাম সাংবাদিক আনিস আহমেদ যুদ্ধাপরাধীদের সম্পর্কে একটা প্রতিবেদন করার সাহায্যের জন্য আপনার কাছে গিয়েছিলেন ..."
প্রশ্ন শেষ করবার আগেই আবেদ সাহেব উত্তর দিলেন,"ওহ, ছেলেটা তো অনেকদূর এগিয়েছিল। আমি তাকে অনেক সাহায্যও করেছিলাম, সে প্রায় প্রতিদিনই আমার অফিসে আসতো। সে যে এখনো নিখোঁজ আছে এটা নিসন্দেহে তৎকালীন রাজাকারদের কাজ যারা চায় না সত্যটা প্রকাশিত হোক .... "

ঘরে ফিরে ক্লান্ত আবেদ সাহেব বিছানায় মাথা রাখামাত্র ঘুমে তলিয়ে গেলেন এবং প্রায় সাথে সাথেই তাঁর অতি পরিচিত দুঃস্বপ্নটা দেখা শুরু করলেন।

বিশাল প্রান্তর ... আবেদ সাহেব সেখানে দাঁড়িয়ে। তাঁর চারদিকে বৃত্তাকারে দাঁড়িয়ে আছে অনেক লোক ... কাউকেই মানুষ বলে চেনা যায় না ... কারো মাথার একটা অংশ নেই ... কারো সারা শরীরে বুলেটের চিহ্ন। তাদের মধ্য থেকে ঝাঁঝরা বুকের এক বৃদ্ধ বলে উঠল,"কিগো আবেদ মিয়া, এখনো বাঁইচা আছো? আমাগো ধরাইয়া দিয়া তুমি বাঁইচা আছো এখনো?" আরেক জন বুদ্ধের পাশ থেকে বলে উঠল,"আমারে তুমি চাচা ডাকতা বাবা, তুমি কেমনে পারলা আমারে আর আমার পোলারে ঐ জানোয়ারগুলার রাইফেলের সামনে খাড়া করায় দিতে? " আরেক তরুণ বলে উঠল,"তুই আমার ছোটবেলার বন্ধু ছিলি বলে তোকে বিশ্বাস করেছিলাম, সবার আপত্তিকে পাত্তা না দিয়ে তোকে মুক্তিবাহিনীতে নিয়েছিলাম ... সেই তুই কিনা আমার পুরো বাহিনীকে তুলে দিলি ঐ জল্লাদদের হাতে? একটি গ্রামকে শেষ করে দিলি তুই ?" সাংবাদিক আনিস কাছেই ছিল, সেও যোগ দিল, "মাত্র বাইশ বছর বয়স ছিল আমার স্যার। সত্যটা জানতে চাওয়াই কি আমার অপরাধ ছিল? আপনি আমকে আপনার গুন্ডা বাহিনী দিয়ে খুন করিয়ে এমন ভাবে আমার লাশকে টুকরো করলেন যে আমার মা বাবা আর কোন দিনই আমার চেহারা দেখতে পারবে না? স্যার আমাকে কি রেহাই দেওয়া যেত না?"

আবেদ সাহেব ভয় পেয়ে একটু পিছিয়ে গেলেন। ওরা বৃত্তটাকে ছোট করে ফেলছে।

মাথায় বুলেটের ফুটো নিয়ে আনিস বলল,"ভন্ড মুক্তিযোদ্ধা সেজে আপনি আর কতদিন আপনার পরিবার, সমাজ আর জাতিকে ধোঁকা দেবেন? আজ আমার মুখ বন্ধ করিয়েছেন ... কিন্তু কেউ না কেউ একদিন আপনার মুখোশ খুলবেই ... লোকে জানবে আপনি একজন রাজাকার!"

"না! কেউ জানতে পারবে না ! " আবেদ সাহেব পাগলের মতো চেঁচালেন, "সবাই জানে আমি মুক্তিযোদ্ধা ... আমি-আমি কাউকে জানতে দেব না ... সবাইকে আমি সরিয়ে দেব ... শেষ করে ফেলব ..."

"ওরা জানবে ... একদিন সবাই জানবে ..." আনিস বলল আর... রক্তমাখা মুখে ভয়ংকরভাবে সে হেসে উঠল। সেই সাথে অন্যরাও অপ্রকৃতিস্থদের মতো সমস্বরে হাসতে লাগল হা হা করে ... আবেদ সাহেবের মেরুদন্ড দিয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেল ... এর মাঝে তিনি শুনতে পেলেন তারা সবাই বলছে "মর, মর, তুই মর আবেদ ... তোর ধ্বংস হোক ... তোর ফাঁসি হোক ..."

আবেদ সাহেব ধড়ফড় করে বিছানায় উঠে বসলেন। তাঁর সারা শরীর ঘামে ভিজে গেছে। আবারো একই দুঃস্বপ্ন। গত বেয়াল্লিশ বছর ধরে ডিসেম্বর মাসে একই স্বপ্ন দেখছেন তিনি। না জানে আরো কতবার দেখতে হবে!

0 মন্তব্য(গুলি):